চৈত্রের দুপুরে খর রোদে যেন আরও শীর্ণ হয়েছে ফরিদপুর শহরের কুমার নদ। তাপ উঠে আসছে মাটি থেকেও। শহরের অম্বিকাপুরের আলো–হাওয়ায় পল্লিকবি জসীমউদ্দীনের কলমে উঠে এসেছিল ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’, ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’–এর মতো সাহিত্যগাথা। ২ এপ্রিল দুপুরে প্রখর রোদের ভেতর গিয়ে দেখা গেল, পল্লিকবির বাড়ির কাছে অম্বিকাপুরের গোবিন্দপুরে যেন আরেক ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ বানিয়েছেন কৃষক সাহিদা বেগম।
সাহিদা মাঠজুড়ে ফলিয়েছেন ‘কালো সোনা’ বলে পরিচিত পেঁয়াজের দানা। কদমের মতো সাদা কেশরের ফুল ফুটে আছে সেখানে। মৌমাছি কমেছে বলে আশপাশে রয়েছে হলদে রঙের ‘হরপা’ নামের একধরনের ফুল গাছ। ওই দিন দুপুরে চড়া রোদে মাঠে ফসলের তদারক করছিলেন সাহিদা। তিনি ফরিদপুর ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জায়গায় উন্নত জাতের পেঁয়াজবীজ উৎপাদন করে পরিচিতি পেয়েছেন।
সাহিদা বললেন, ‘পেঁয়াজের সাদা কদম শুকিয়ে গেলে ঝরে পড়ে কালো দানা কিংবা বা বীজ। এ বীজের দাম অনেক। ফুলগুলো বড় করতে হয় অনেক ধৈর্য নিয়ে।’ তিনি জানান, মাঠ থেকে তুলে নিয়ে শুকিয়ে মলন দিয়ে বের করতে হয় সেই কালো সোনা। এ কাজে ঝুঁকি অনেক। কারণ, কয়েক মাস ধরে মাঠে বড় করতে হয়। বৃষ্টিপাত, গরম—সবকিছু প্রভাব ফেলে উৎপাদনে। যদিও এখানে যত ঝুঁকি, তত লাভ।
পরিশ্রমী সাহিদা দেশসেরা নারী কৃষকদের একজন। ২০০৪ সালে মাত্র ২০ শতাংশ জায়গায় তিনি চাষাবাদ শুরু করেছিলেন। এ বছর তিনি দেশের বিভিন্ন জেলায় মোট ১০ হাজার শতাংশ জমিতে চাষাবাদ করেছেন।
প্রতিদিন সাহিদার কাজকর্ম শুরু হয় ভোরে। পরিবারের সদস্যসহ কৃষিশ্রমিকদের জন্য নিজে রান্না করেন। সকালের খাবার খেয়ে চলে যান খেতে। জমিতে কাজের তদারক করেন। সেখানেই বিকেল গড়ায়। কোনো এক ফাঁকে হয়তো বাসায় ফেরেন। কাজের চাপ থাকলে শ্রমিকদের সঙ্গে মাঠে বসে যান থালা হাতে, দুপুরের খাবার নিয়ে।
কাজ শুরু করেন ভোরে
প্রতিদিন সাহিদার কাজকর্ম শুরু হয় ভোরে। পরিবারের সদস্যসহ কৃষিশ্রমিকদের জন্য নিজে রান্না করেন। সকালের খাবার খেয়ে চলে যান খেতে। জমিতে কাজের তদারক করেন। সেখানেই বিকেল গড়ায়। কোনো এক ফাঁকে হয়তো বাসায় ফেরেন। কাজের চাপ থাকলে শ্রমিকদের সঙ্গে মাঠে বসে যান থালা হাতে, দুপুরের খাবার নিয়ে।
অথচ শুরুটা ছিল অভাবের সংসারে একটু সচ্ছলতার প্রত্যাশায়। এখন পেঁয়াজ তোলার সময় সাহিদার ফসলের মাঠে কাজ করে তিন শর বেশি শ্রমিক। মৌসুম ছাড়াও রোজ থাকেন ৫০ থেকে ৬০ জন করে। তাই সাহিদাকে একজন উদ্যোক্তা হিসেবেও চেনে মানুষ।
নিজের ফসলের খেতে নারী কৃষক সাহিদা বেগম
নিজের ফসলের খেতে নারী কৃষক সাহিদা বেগমছবি: প্রথম আলো
আজকের এই অর্জনের পেছনের গল্পটা খুব সরল নয়। অভাবী কৃষি পরিবারের বউ হয়ে এসেছিলেন। গায়ের রং কালো বলে অবহেলাও ছিল পরিবারের কারও কারও। সাহিদা প্রথম আলোকে বললেন, ‘ঢেঁকি পাড়াতে দিলে হাঁপিয়ে যেতাম। তবু ভাবতাম কাজ করলে হয়তো আমাকে ভালোবাসবে। রোদের মধ্যে কাজ করতে করতে ভাদ্র, চৈত্র মাসের গরমের ভয় ভেঙেছে। তাই দিন–রাত শুধু কাজ করার চেষ্টা করতাম। এভাবেই একসময় শুরু করি পেঁয়াজবীজ উৎপাদন। যদিও কোনো দিন ভাবিনি, এতটা পথ আসতে পারব।’
সাহিদা এ মৌসুমে ফরিদপুরে ৪০ একর, উত্তরবঙ্গের ঠাকুরগাঁও–দিনাজপুরে ৬০ একর জমিতে পেঁয়াজবীজের চাষ করেছেন। তিনি চাতাল ভাড়া নিয়ে কাজ করেন। সাহিদার কাছ থেকে বীজ নিয়ে পাবনার কৃষকেরা চাষ করছেন। এ যাত্রায় ব্যাংক কর্মকর্তা স্বামী বক্তার হোসেন খানের কাছ থেকে সব সময় উৎসাহ পেয়েছেন তিনি।
পেয়েছেন স্বীকৃতি
নারী কৃষক সাহিদা ২০২১ সালে এআইপি হয়েছেন। কৃষিক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের এই সম্মাননা দেয় কৃষি মন্ত্রণালয়। কৃষি উৎপাদন বা বাণিজ্যিক খামার স্থাপন ও কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্প শ্রেণিতে তিনি এ সম্মান পেয়েছেন। ২০২০ সালে তিনি অনন্যা শীর্ষ দশ নির্বাচিত হয়েছেন। একই বছর দেশের সেরা কৃষক হিসেবে পেয়েছেন স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড চ্যানেল আই অ্যাগ্রো অ্যাওয়ার্ডসহ নানা স্বীকৃতি।
‘খান বীজ’ নামে পেঁয়াজবীজের ব্র্যান্ড গড়ে তুলেছেন সাহিদা বেগম
‘খান বীজ’ নামে পেঁয়াজবীজের ব্র্যান্ড গড়ে তুলেছেন সাহিদা বেগমছবি: প্রথম আলো
২ এপ্রিল দুপুরে গোবিন্দপুরের মাঠ থেকে সাহিদার সঙ্গে তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, বাড়ির সবকিছুই সাজানো হয়েছে ফসলকে ঘিরে। ফসল শুকানো, মাড়াই, বাছাই, সংরক্ষণ, প্যাকেটজাত, বিপণনের পাশাপাশি আছে একসঙ্গে ৫০ জন মানুষ ঘুমানোর ঢালা বিছানা। বাড়ির ভেতর দিকে টানা উঠানে ফসল শুকানোর জায়গা। সামনে রাস্তার উল্টো পাশে চারা তৈরির জায়গা। আর বাড়ির পেছন দিকে শ্রমিকদের থাকা খাওয়া এবং ফসল সংরক্ষণের ঘর। সেখানে বিশেষ ব্যবস্থায় মেঝে থেকে বাতাস ছড়িয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
সাহিদা জানালেন, পেঁয়াজের বীজ পেতে ছয় মাস জমিতে কাজ করতে হয়। নভেম্বর থেকে রোপণ শুরু হয় এবং খেত থেকে বীজ শুকিয়ে প্রস্তুত করতে এপ্রিল-মে মাস পর্যন্ত সময় লাগে। বীজ বিক্রি করতে করতে সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর মাস চলে যায়। তাই সারা বছর অসংখ্য শ্রমিক থাকেন এখানে। তাঁদের থাকা–খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হয়।
আরও পড়ুন
‘কালো সোনা’র খেতে কৃষকের ব্যস্ততা
১৪ মার্চ ২০২৫
উপকারী পাখি খেতের মধ্যে বসবে—সেই আশায় বাঁশের কঞ্চি পুঁতে রাখা হচ্ছে
সচ্ছলতার প্রত্যাশায় শুরু
জানতে চাই শুরুর গল্পটা। সফল নারী কৃষক সাহিদা স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসলেন। বললেন, ‘শুরুটা করেছিলাম সংসারে সচ্ছলতা আনতে। ২০০৪ সালে অল্প জমিতে শুরু করে দুই মণ বীজ পেয়েছিলাম। ৮০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। বুঝলাম, বীজ তৈরি করতে পারলে এর চাহিদা ব্যাপক। এর পর থেকে ধীরে ধীরে আমি জমি বাড়াতে শুরু করি। বিএডিসি থেকে প্রশিক্ষণ নিই।’
সাহিদা এ মৌসুমে ফরিদপুরে ৪০ একর, উত্তরবঙ্গের ঠাকুরগাঁও–দিনাজপুরে ৬০ একর জমিতে পেঁয়াজবীজের চাষ করেছেন। তিনি চাতাল ভাড়া নিয়ে কাজ করেন। সাহিদার কাছ থেকে বীজ নিয়ে পাবনার কৃষকেরা চাষ করছেন। এ যাত্রায় ব্যাংক কর্মকর্তা স্বামী বক্তার হোসেন খানের কাছ থেকে সব সময় উৎসাহ পেয়েছেন তিনি।
‘কালো সোনা’ হিসেবে পরিচিত পেঁয়াজের দানা বা বীজ
‘কালো সোনা’ হিসেবে পরিচিত পেঁয়াজের দানা বা বীজছবি: প্রথম আলো
সাহিদার ভাষ্য, ‘পেঁয়াজের দানা চাষ খুব কষ্টসাধ্য কাজ। শিশু লালনপালন করার মতো যত্ন ও নজরদারির প্রয়োজন হয়। একসময় প্যাকেট না করে বীজ বিক্রি করায় বিপদে পড়তে হয়েছে। ব্যাপারীরা অন্য পেঁয়াজের বীজ মিশিয়ে বিক্রি করে দিত। এতে কৃষক কাঙ্ক্ষিত ফলন পেতেন না। আমার বদনাম হতো।’ এখন সাহিদা ‘খান বীজ’ নামে পেঁয়াজের প্যাকেটজাত বীজ বিক্রি করছেন।
সাহিদা বেগম পেঁয়াজবীজের নানা রকম ধরন নিয়ে কাজ করছেন বলে জানান ফরিদপুর বিএডিসির যুগ্ম পরিচালক (বীজ প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র) এস এম ইকরামুল হক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাহিদা বেগম ফরিদপুরে ভালো বীজ উৎপাদনকারীদের মধ্যে অন্যতম। তিনি একজন উদ্যোক্তাও। উত্তরবঙ্গেও অনেক জায়গা নিয়ে তিনি বীজ উৎপাদনের কাজ করছেন। একজন নারী কৃষক হিসেবে তিনি একাই যে পরিমাণ মানুষের কর্মসংস্থান করেছেন, তা দৃষ্টান্ত।’
আরও পড়ুন
কোটিপতি চাষি সাহিদা বেগম
০১ ডিসেম্বর ২০২০
কোটিপতি চাষি সাহিদা বেগম
ধৈর্য–শ্রমের সুফল মিলেছে
ঈদের ছুটির মধ্যেও সেদিন দুপুরে সাহিদা মাঠে ফসলের তদারক করছিলেন। তাঁর স্বামী তখন বাড়িতে ডিলারদের সঙ্গে টাকাপয়সার হিসাব করছিলেন। বক্তার হোসেন খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘মৌমাছির আশ্রয়স্থল কমে গেছে। ফলে বীজের পরাগায়ন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বীজ ভালো হচ্ছিল না। ফলন কমে গিয়েছিল। বাংলাদেশে আমরাই প্রথম হাত দিয়ে পেঁয়াজের বীজের পরাগায়ন শুরু করি। অনেক রকম ঝুঁকি আছে এ কাজে।’
বক্তার হোসেন খান বললেন, ‘আমার স্ত্রী অসম্ভব ধৈর্য নিয়ে, শ্রম দিয়ে এবং হিসাব করে করে চাষের জমির পরিমাণ বাড়িয়েছেন। এসবের সুফলও তিনি পেয়েছেন।’
ফরিদপুর বিএডিসির উপপরিচালক (চুক্তিবদ্ধ চাষি) আখতারুজ্জামান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই নারী কৃষক প্রায় ১০০ একর জমিতে বীজ উৎপাদন করেন। এতে দেশের পেঁয়াজবীজের চাহিদার উল্লেখযোগ্য অংশ তাঁর এখান থেকে আসে। এবার সাহিদার কাছ থেকে দুই টনের মতো বীজ সংগ্রহ করবে সরকার।’
আরও পড়ুন
মাঠে দোল খাচ্ছে সাদা ফুলের ‘কালো সোনা’
০৩ এপ্রিল ২০২১
মাঠে দোল খাচ্ছে সাদা ফুলের ‘কালো সোনা’
পরিশ্রম উন্নতির মূলে
বিদায়বেলায় সাহিদার কাছে জানতে চাইলাম, নারী হয়ে এত ঝুঁকি নেওয়ার সাহস পেলেন কীভাবে? বললেন, ‘আমরা হচ্ছি সত্যিকারের কৃষক। শুরুর দিকে অনেক মানুষ ব্যঙ্গ করত। নারী হয়ে মাঠে–ঘাটে কাজ করা নিয়ে হাসাহাসি করত। এখন তারাই বাহবা দিয়ে যায়। এ সাফল্যের পেছনে আছে আমার রোদে পুড়ে খাক হওয়ার কষ্ট। বাতাস হলে মাঠে ছুটে যাওয়ার শ্রম। ফসলের চিন্তায় রাতে না ঘুমানোর যন্ত্রণা।’
এগিয়ে দিতে গিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কবি জসীমউদ্দীনের বাড়ি পর্যন্ত এলেন সাহিদা। এ বাড়ির উল্টো দিকেই বয়ে চলেছে শীর্ণ কুমার। ওপারে আদমপুর। সেখানেও মাঠজুড়ে ‘কালো সোনা’ ফলিয়েছেন সাহিদা। বিদায় নেওয়ার আগে সাহিদা বললেন, ‘নিজেও জানতাম না এতটা পথ আসতে পারব। শুধু পরিশ্রম থামাইনি কখনো। একদিন অনাদরে বহু আঘাত পেয়েছি। আজ সেই কষ্ট সোনার ফসল হয়ে আসছে আমার ঘরে।’