বিশ্বের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের দিকে লক্ষ করলে দেখা যাবে, যুগে যুগে অন্যায়, অত্যাচার, অবিচারের বিরুদ্ধে সবার আগে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে তরুণ সমাজ। দেশ-জাতি-সমাজের রক্ষাকবচ হয়েছে। তারুণ্যের মাঝে যেন এক অবিনাশী শক্তি থাকে, যে শক্তিবলে তারা ন্যায়-অন্যায়ের বিভেদ কাটিয়ে উঠতে পারে, সত্য-মিথ্যার ফারাক বুঝতে পারে। এজন্যই মূলত বলা হয়, আজকের তরুণেরাই আগামী দিনে দেশ ও জাতির পথপ্রদর্শক হবে। তাদের হাতেই নির্মিত হবে জাতির ভবিষ্যত্। সুতরাং এই তরুণদের যদি তারুণ্যের শক্তিতে উজ্জীবিত করা না যায়, তাহলে দেশ ও জাতিকে পড়তে হবে ঘোর অমঙ্গলের মুখে।
স্বাধীনতাযুদ্ধের নেপথ্যে আমাদের চেতনা ছিল একটি সুখী, সমৃদ্ধশালী দেশ গড়ে তোলা। এই সুখী দেশ গড়ে তুলতে একদিকে যেমন প্রয়োজন অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, ভূরাজনৈতিক, কূটনৈতিক ক্ষেত্রে সমৃদ্ধি অর্জন করা, তেমনিভাবে জরুরি একটি দক্ষ জনগোষ্ঠী ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় মনোযোগী হওয়া। কেননা, অর্থনৈতিক সক্ষমতা আমাদের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করতে পারে, সামাজিক সক্ষমতা আমাদের সামাজিক ভিত্তিকে মজবুত করতে পারে; কিন্তু সেই ভিত্তিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য অবধারতিভাবে প্রয়োজন পড়বে একটি দক্ষ জনগোষ্ঠীর। আর এই দক্ষ জনগোষ্ঠী গঠনে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের কোনো বিকল্প নেই।
স্বাধীনতার পাঁচ দশকে আমরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সাফল্য দেখিয়েছি। বিশেষ করে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে আমরা স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধন করেছি, মেট্রোরেল নির্মাণ করেছি, কর্ণফুলী টানেল চালু করেছি, মহাকাশে নিজেস্ব স্যাটেলাইট উেক্ষপণ করেছি। এক কথায়, প্রযুক্তি ও অবকাঠামোগত ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি করেছি। যদিও এসব ক্ষেত্রে আমাদের নির্ভর করতে হয়েছে বহির্বিশ্বের ওপরে। এসব প্রযুক্তি আমদানি করতে বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রগুলোর দ্বারস্থ হতে হয়েছে। এর কারণ, মানসম্পন্ন প্রযুক্তি উত্পাদনে আমরা এখনো সেভাবে সক্ষম হয়ে উঠতে পারিনি। এমনকি এই প্রযুক্তি পরিচালনা করার মতো দক্ষ জনশক্তিও এখনো গড়ে ওঠেনি।
আশার কথা হচ্ছে, আমাদের বৃহত্ একটি জনগোষ্ঠী আছে। এই জনগোষ্ঠীকে যদি একটি জনশক্তিতে রূপান্তর করা যায়, তাহলে জাতির এগিয়ে যাওয়ার পথ আরো ত্বরান্বিত হবে। এজন্য প্রথমেই দরকার একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজব্যবস্থা, যেখানে থাকবে জ্ঞানের বিকাশ ও চর্চার জন্য যথোপযুক্ত পরিবেশ। জ্ঞানকে দেশের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। বিশেষ করে নতুন প্রজন্মকে এ ব্যাপারে বেশি করে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
পরিতাপের বিষয় হলো, আগামীর বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়ার মতো যথেষ্ট শক্তি ও সাহসের ঘাটতিই বেশি পরিলক্ষিত হয় আজকের নতুন প্রজন্মের মধ্যে। এর একটি বড় কারণ, বইবিমুখ এই প্রজন্ম ঝুঁকে পড়েছে সোশ্যাল মিডিয়ার দিকে। সোশ্যাল মিডিয়াভর্তি মানহীন ও কুরুচিকর কনটেন্ট থেকে তারা যে মেসেজ পাচ্ছে, তা আসলেই ক্ষতিকর, মারাত্মক ও ভয়ংকর। ফলে শিশুকাল থেকেই তাদের মেধা বিকাশের ঘাটতি থেকে যাচ্ছে এবং বোধোদয় বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বাস্তবিক সমস্যা সমাধানের সক্ষমতা তৈরি না হওয়ার কারণে দেশ-সমাজ-রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধয়তার ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে ‘উদাসীনতা’ শিকড় গজিয়ে বসছে। অথচ এই বোধহীন ও উদাসীন তরুণেরাই আগামী দিনের শাসক, প্রশাসক, নিয়ন্ত্রক—ভাবা যায়!
সুতরাং এই নতুন প্রজন্মকে যদি আমরা জাগ্রত করতে না পারি, তাদের বোধের জানালায় টোকা দিতে সক্ষম না হই, তাহলে আমাদের জাতীয় জীবনের সব সমৃদ্ধি ও অর্জন আগামী দিনে স্থবির হয়ে যাবে। এই প্রজন্মকে বইয়ের কাছে ফিরিয়ে আনা সময়ের দাবিতে পরণিত হয়েছে অনেক আগেই। বই মানুষকে খাদমুক্ত করার মধ্য দিয়ে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, সর্বোপরি বিশ্বের জন্য প্রস্তুত করে তোলে। বই আলোর দিশারি। আমাদের নতুন প্রজন্ম যখন এই আলোর সন্ধান খুঁজে পাবে, কেবল তখনই সুখী, সমৃদ্ধিশালী সোনার বাংলাদেশ বিনির্মাণ সম্ভব হবে।