প্রথমবারের মতো নারী নেতাকর্মীকে সর্বসমক্ষে এনেছে জামায়াতে ইসলামী। অতীতে দলটির নারী নেতাকর্মীর অংশগ্রহণ ছিল সাংগঠনিক ও ধর্মীয় কার্যক্রমের মধ্যে নিয়ন্ত্রিত। সম্প্রতি কূটনীতিক ও রাজপথে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে তাদের উপস্থিতি চোখে পড়ছে। একে জামায়াতের উদারীকরণ হিসেবে দেখছেন অনেকে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, জামায়াতের অবস্থান এতদিন নারীর পক্ষে ছিল না। ভোটারের অর্ধেক যেহেতু নারী, তাই এটা তাদের নির্বাচনী কৌশল হতে পারে।
যদিও জামায়াত নেতারা বলছেন, নীতি-আদর্শে বদল আসেনি। আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে জামায়াতের ওপর দমনপীড়নের কারণে নারী নেতাকর্মীকে প্রকাশ্য কর্মসূচিতে দেখা যায়নি। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের পতনে নিরাপদ পরিবেশে নারী নেতাকর্মীরা ইসলামের বিধিবিধান ও পর্দা মেনে রাজনৈতিক কর্মসূচিতেও প্রকাশ্য হয়েছেন। সাংগঠনিক, ধর্মীয় ও সামাজিক কার্যক্রম আগের মতোই অব্যাহত রয়েছে।
জামায়াতের একাধিক নেতা সমকালকে বলেন, পশ্চিমা দেশগুলোর প্রধান জিজ্ঞাসা, নারীর প্রতি জামায়াতের দৃষ্টিভঙ্গি কী? নারীদের কার্যক্রম প্রকাশ্যে আসায়, তা স্পষ্ট হয়েছে। তবে এক নেতা বলেন, শুধু কূটনৈতিকদের প্রশ্নে নয়, সময়ের সঙ্গে পরিবর্তনের প্রয়োজনেই দলীয় সিদ্ধান্তে নারী নেতাকর্মীর কার্যক্রম প্রকাশ্যে আনা হয়েছে। যদিও নেতাদের একাংশ এর পক্ষে ছিলেন না। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠতায় নেওয়া সিদ্ধান্ত সবাই মেনে নিয়েছেন।
নীতি বদল হচ্ছে
দলটির এক নেতা সমকালকে বলেন, টেলিভিশন দেখা কিংবা টেলিভিশনের কার্যক্রমে অংশ নেওয়া ইসলামসিদ্ধ কিনা– এ বিতর্ক একটা সময় হয়েছে। পরে সময়ের প্রয়োজনে এবং ইতিবাচক ব্যবহারের দিকগুলো স্পষ্ট হওয়ায় টেলিভিশনকে বৈধতা দিয়েছেন ইসলামী চিন্তাবিদরা। নারীর কার্যক্রম প্রকাশ্যে আনার বিষয়টি তেমনই।
আওয়ামী লীগ শাসনামলে ধরপাকড়ে কোণঠাসা জামায়াত শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর প্রকাশ্য রাজনীতিতে ফিরে নারীর প্রতি উদার হওয়ার বার্তা দিচ্ছে। দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমান গত ৩০ নভেম্বর বলেছিলেন, ‘আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হয়, জামায়াত ক্ষমতায় গেলে নারীদের ঘর থেকে বের হতে দেওয়া হবে না। কিন্তু কথা দিচ্ছি, এমন হবে না। তাদের পোশাক নিয়ে আমরা বাধ্য করব না।’
সামাজিক মাধ্যমে জামায়াতের রক্ষণশীল কর্মী-সমর্থকরা এ বক্তব্যের সমালোচনা করলেও দলীয় প্রধান নারীদের ঘরের বাইরে কাজের সুযোগের পক্ষে বলছেন। জামায়াত আগামী জাতীয় নির্বাচনে নারী ভোট পক্ষে টানতে অবস্থান বদল করেছে বলে সমালোচনা হলেও গত ৪ জানুয়ারি ডা. শফিক বলেন, ‘নারী বলে কাজের বাইরে রাখা হবে না। নারী তাঁর প্রাপ্য সম্মানের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করবে।’ এর আগে তিনি বলেন, ‘তাদের (নারী) হাত বন্ধ করার আমরা কে?’ এর ধারাবাহিকতায় সপ্তাহখানেক ধরে জামায়াতের নারীদের নজিরবিহীন প্রকাশ্য কর্মসূচি দেখা যাচ্ছে।
নারীরা আসছেন প্রকাশ্যে
ধর্ষণ, নারী ও শিশু নিপীড়নের প্রতিবাদে পাঁচ দফা দাবিতে গত শনিবার রাজধানীর প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করে জামায়াতের মহিলা বিভাগ। হাজারখানেক নারী নেতাকর্মী মানববন্ধনে অংশ নিয়ে ধর্ষণের বিচার দাবিতে স্লোগান ও বক্তব্য দেন। অতীতে কখনই জামায়াতের নারী নেতাদের প্রকাশ্যে স্লোগান কিংবা বক্তব্য দিতে দেখা যায়নি।
গত বৃহস্পতিবার জামায়াতপন্থি সংগঠন নারী অধিকার আন্দোলন প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করে। দুটি কর্মসূচিতেই অংশগ্রহণকারী জামায়াতের নারী নেতাকর্মীরা বোরকা পরিহিত ছিলেন, মুখ ঢাকা ছিল হিজাবে। গত শুক্রবার ময়মনসিংহে নগরীর টাউন হল মিলনায়তনের মতো উন্মুক্ত স্থানে জামায়াতের মহিলা বিভাগের আয়োজনে ‘তাকওয়াভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনে নারীর ভূমিকা’ শীর্ষক সেমিনার হয়। নারী কর্মীর ওপর হামলার প্রতিবাদে ১১ মার্চ ঝিনাইদহের মহেশপুরে সরকারি ডিগ্রি কলেজ মাঠে নারী সমাবেশ করে স্থানীয় জামায়াত। এতে হাজারো নারী নেতাকর্মী বোরকা, হিজাব পরে অংশ নেন। ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসের কর্মসূচিতে স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীরা জামায়াতের নারী নেতাকর্মীর ওপর হামলার প্রতিবাদে ওই সমাবেশ হয়।
১১ মার্চ জামায়াত কার্যালয়ে দলটির আমিরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার সারাহ কুক। এ সময় তাঁর সঙ্গে জামায়াতের চার নারী নেতাও কথা বলেন। নারী নেতাদের সঙ্গে হাইকমিশনারের সাক্ষাতের ছবি জামায়াতের ফেসবুক পেজে পোস্ট করা হয়। জামায়াতের নারী নেতাদের কূটনৈতিকদের সঙ্গে সাক্ষাতের নজির নেই। আগে কখনই নারীদের কার্যক্রমের তথ্য কিংবা ছবি সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়নি।
জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ সমকালকে বলেন, শেখ হাসিনার শাসনামলে ধরপাকড়ের কারণে পুরুষ নেতাকর্মীরা সভা-সমাবেশ দূরে থাক ঘরোয়া বৈঠকও করতে পারতেন না। নারীদের জন্য পরিবেশ ছিল আরও অনিরাপদ। সে কারণেই নারীদের এতদিন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে দেখা যায়নি। এখন নিরাপদ পরিবেশ হওয়ায় ইসলামী বিধান অনুসরণ করে নারীরা প্রকাশ্য কার্যক্রম চালাচ্ছেন। ধর্ষণ, নিপীড়নবিরোধী কর্মসূচি যতটা না রাজনৈতিক, তার চেয়ে বেশি সামাজিক। সামাজিক কার্যক্রম মহিলা জামায়াতের নিয়মিত কাজের অংশ।
মহিলা জামায়াতের কার্যক্রম ও নারী প্রতিনিধিত্ব
বিএনপি এবং অন্যান্য মধ্যপন্থি দলের নারী শাখা থাকলেও জামায়াতের রয়েছে মহিলা বিভাগ। এর নেতৃত্বে রয়েছেন একজন সেক্রেটারি। মহিলা বিভাগের কার্যক্রম জামায়াতের মূল কার্যক্রম থেকে আলাদা। মহিলা বিভাগ এলাকাভিত্তিক নিজস্ব কমিটির মাধ্যমে কার্যক্রম চালায়। নির্বাচনে নারী ভোট টানতে মহিলা বিভাগ গ্রাম-শহরনির্বিশেষে ঘরে ঘরে সাংগঠনিক দাওয়াতি কাজ করে। ‘প্রোগ্রাম’, ‘তালিম’ নামে পরিচিত ঘরোয়া বৈঠকের মাধ্যমে জামায়াতের সহযোগী সদস্য, কর্মী হিসেবে নারীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। নারীদের কোরাআন, হাদিস, ইসলামী সাহিত্যের শিক্ষাও দেওয়া হয় এসব কর্মসূচির মাধ্যমে। শেখ হাসিনার আমলে জামায়াতের অনেক নারী নেতাকর্মী এমন কর্মসূচি থেকে গ্রেপ্তারও হয়েছেন।
উপজেলা, জেলা, মহানগর ও কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নির্বাচনে মহিলা বিভাগের রোকন (সদস্য) এবং নারী নেতারা ভোটদানের অধিকারী। জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার ৩৮২ সদস্যের প্রায় ৪০ শতাংশ নারী। কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সক্রিয় ৫২ সদস্যের প্রায় ৪০ শতাংশ নারী। যদিও সর্বোচ্চ ফোরাম ২১ সদস্যের নির্বাহী পরিষদে একজন নারীও নেই। হামিদুর রহমান আযাদ সমকালকে বলেন, মজলিসে শূরা জামায়াতের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক। এর ৪০ শতাংশ সদস্য নারী। অন্য কোনো দলে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে এত বেশি নারী প্রতিনিধিত্ব নেই।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জিজ্ঞাসায় জামায়াত
জামায়াত সূত্র জানিয়েছে, জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সঙ্গে ৫ আগস্টের পর যেসব বৈঠক হয়েছে, তাতে নারী স্বাধীনতা, কর্মক্ষেত্রে নারীর অধিকারের বিষয়ে জামায়াত নেতাদের কাছে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি জানতে চাওয়া হয়েছিল। দলটির নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের সমকালকে বলেন, আওয়ামী লীগ এবং তাদের দোসররা সাড়ে ১৫ বছর বিদেশিদের কাছে জামায়াতকে ভুলভাবে চিত্রায়িত করেছে। জামায়াতকে কট্টরপন্থি, সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে তুলনা করে তথ্য দিয়েছে। ৫ আগস্টের পর কূটনৈতিকরা কার্যক্রম দেখে আশ্বস্ত হয়েছেন, জামায়াত একটি গণতান্ত্রিক ইসলামী দল। জামায়াত নারীর স্বাধীনতা ও অধিকারের পক্ষে। ইসলাম নারীকে স্বাধীনতা, সম্মান, অধিকার দিয়েছে। জামায়াত তা অনুসরণ করে। জামায়াতের মহিলা বিভাগ নিজস্ব কর্মপদ্ধতিতে কার্যক্রম চালায়।
দলটির এক নেতা সমকালকে বলেন, জামায়াতের মহিলা বিভাগের নেতারা পেশায় চিকিসৎক, প্রকৌশলী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আইনজীবী; তা জেনে বিটিশ হাইকমিশনার বিস্মিত হয়েছেন। নারী নেতারা তাঁর সঙ্গে সাবলীল বৈঠক করায় নতুন ধারণা পেয়েছেন।
নির্বাচনে জামায়াতের নারী নীতি
১৯৯১ সালে পঞ্চম সংসদে সংরক্ষিত মহিলা আসনে জামায়াতের দু’জন নারী এমপি ছিলেন। অষ্টম সংসদে দলটির নারী এমপি ছিলেন তিনজন। তারা ছিলেন সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি। জামায়াত কখনই সংসদ নির্বাচনে নারী প্রার্থী দেয়নি। তবে স্থানীয় নির্বাচনে নারী প্রার্থী নিয়মিত দিয়েছে। ২০১৪ সালের উপজেলা নির্বাচনে নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদে জামায়াত সমর্থিত ৩৬ জন জয়ী হয়েছিলেন। ২০০৯ সালে জাময়াত সমর্থিত নারী প্রার্থীরা জয়ী হয়েছিলেন ১২ উপজেলায়। ২০১৫ সালে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর পদে জামায়াতের নারী নেতা জয়ী হয়েছিলেন।
আগামী সংসদ নির্বাচনে জামায়াত নারী প্রার্থী দিতে পারেন– এমন গুঞ্জন রয়েছে। গত ১১ ডিসেম্বর সাক্ষাৎকারে জামায়াত আমির সমকালকে জানিয়েছিলেন, যোগ্য হলে প্রার্থী হিসেবে নারীদের বিবেচনা করা হতে পারে।
ভোটের হিসাব ও রক্ষণশীল বিরোধিতার শঙ্কা
তবে জামায়াতের এক নেতা সমকালকে ধারণা দিয়েছেন, কওমি ধারার ইসলামিক দলগুলোর সঙ্গে আগামী নির্বাচনে জোট কিংবা সমঝোতার কথা চলছে। এসব দল নারী নেতৃত্বের ব্যাপারে রক্ষণশীল। জোট হলে নারী প্রার্থী করা সম্ভব হবে না। নারী নেতাকর্মীকে প্রকাশ্যে আনার বিষয়টি বেশি আলোচিত হলে কওমি ধারার দলগুলোর আপত্তিতে নির্বাচনে জোট বা সমঝোতার চেষ্টা বিঘ্নিত হতে পারে। সাধারণ শিক্ষাগ্রহণ, নারীকে বাইরের কাজের অধিকারকে সমর্থন, নারী নেতৃত্ব রয়েছে– এমন দলের সঙ্গে জোটের কারণে রক্ষণশীল এই দলগুলোর অনেকে এমনিতেই জামায়াতকে ইসলামিক দল হিসেবে মানতে চান না।
জামায়াতের এক নেতা বলেন, ভোটারের ৫০ শতাংশ নারী হওয়া তাদের সমর্থন ছাড়া কোনো দলের পক্ষে নির্বাচনী সাফল্য সম্ভব নয়। মহিলা বিভাগের ঘরে ঘরে কাজের কারণে গ্রামীণ অঞ্চলে নারীদের মধ্যে জামায়াতের সমর্থন অন্য দলের তুলনায় বেশি। শুধু ভোটে জিততে জামায়াত নারীর প্রতি উদার হচ্ছে, অন্যান্য ইসলামী দলের মতো নারীর প্রতি জামায়াতের দৃষ্টিভঙ্গি কঠোর নয়- এমন ধারণা ছড়ালে ক্ষতি হবে। আবার জামায়াত নারীর প্রতি উদার নয়– এ ধারণাও ক্ষতিকর। তাই সব দিক বিবেচনায় এগোতে হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন সমকালকে বলেন, রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের অবস্থান এতদিন নারীর পক্ষে ছিল না। ভোটারের অর্ধেক নারী, তাই এটা নির্বাচনী কৌশল হতে পারে। জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে ৪০ শতাংশ নারী প্রসঙ্গে তিনি বলেন, উপস্থিতি থাকলেই মতামত থাকে না। নীতিনির্ধারণে নারীদের মতামত নেওয়া হচ্ছে কিনা, তা গুরুত্বপূর্ণ।