সাল ২০১৮। পার্শ্ববর্তী দেশের জনপ্রিয় রিয়্যালিটি ‘সা রে গা মা পা’য় একের পর এক ধামাকা পারফরম্যান্স উপহার দিচ্ছেন বাংলাদেশের এক যুবক। তখনো সেভাবে দেশের মানুষ তাকে চিনতে পারেননি। কিন্তু কবি নজরুলের কারার ঐ লৌহকপাট, নগর বাউল জেমসের মা ও আইয়ুব বাচ্চুর এই রুপালি গিটার ততদিনে কলকাতার মানুষের কাছে তাকে আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছে। এরপর তার জনপ্রিয়তার খবর রটে যায় বাংলায়। অল্প সময়েই দেশের মানুষের কাছ থেকেও পেতে থাকেন অসম্ভব ভালোবাসা। সেই ভালোবাসা ধরে রাখতে পারেননি তিনি। মুহূর্তেই হারিয়ে যান অন্ধকারের গর্ভে। ধূমকেতুর মতো আসা এই শিল্পীর নাম মাইনুল আহসান নোবেল।
কলকাতার ‘সা রে গা মা পা’য় নোবেল তৃতীয় হয়েছিলেন। তবে ওই আসরে সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রতিযোগী ছিলেন তিনি। একাধিকবার গোল্ডেন গিটার জয়ী হয়েছিলেন তিনি। তবে তিনি তৃতীয় হলেও শ্রোতাদের কাছে তার চাহিদা ছিল সবার চেয়ে বেশি। তাইতো ‘সা রে গা মা পা ২০১৮-১৯’ প্রতিযোগিতা শেষে দেশ ও দেশের বাইরে সবার চেয়ে তার স্টেজ শোর চাহিদা বেড়ে যায়। তিনিও তারকাখ্যাতি নিয়ে দুহাত ভরে অর্থ আয় করতে থাকেন। এর মাঝেই আবার পেয়ে যান দেশের কিংবদন্তি রকস্টার নগর বাউল জেমসের সঙ্গে তুলনা। যেই তুলনা তাকে শেষ করে দিয়েছে বলে সম্প্রতি জানিয়েছেন তিনি। কালবেলার সঙ্গে একান্ত আলাপকালে নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে খোলামেলা কথা বলেন এই শিল্পী। জানান আবার গান ও অভিনয়ে ফিরছেন তিনি।
শুরুতেই নোবেল তার হারিয়ে যাওয়ার কারণ নিয়ে বলেন, ‘আমার সব অভিযোগ নিজের ওপরেই। আমি আমাকে যত্ন করতে পারিনি। তাই শ্রোতাদের অসম্ভব ভালোবাসা পেয়েও তা ধরে রাখতে পারিনি। এই দোষ শুধুই আমার। কারণ তারকাখ্যাতি এবং অর্থ একসঙ্গে পেয়ে গিয়েছিলাম, যা আমাকে পথভ্রষ্ট করে দেয়। আমি কোনো কিছুকেই তোয়াক্কা করতাম না, যা মন চাইত তাই করতাম। কোনো কাজকে আমি গুরুত্ব দিতাম না। যাকে তাকে অপমান করে কথা বলতাম। কিন্তু এমনটা করা আমার উচিত হয়নি। যেটি আমি এখন বুঝতে পারছি। তাইতো চার বছর বিরতির পর আবারও ফিরে আসার চেষ্টা করছি। প্রতিনিয়ত নিজকে গড়ার চ্যালেঞ্জ নিচ্ছি। সেই চ্যালেঞ্জে সফল হতে নিজের সঙ্গেই যুদ্ধ করে যাচ্ছি। আশা করছি এবার দর্শকদের ভালোবাসা ধরে রাখতে পারব। কারণ এই ভালোবাসা যদি ধরে না রাখতে পারি তাহলে কালের গর্ভে আমি হারিয়ে যাব একদিন। যেমন হারিয়ে ছিলাম এই চার বছর। দীর্ঘ এ সময়টিতে আমি একটি বিষয় উপলব্ধি করেছি। কাজ ছাড়া আমাকে কেউ মনে রাখবে না, মনে রাখেনি। তাই এবারের ফিরে আসার যুদ্ধ শুধুই আমার একার। কারণ শাস্তি যা পাওয়ার আমি পেয়েছি। এখন এই ভুলগুলো শুধরে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়াই আমার মূল লক্ষ্য।’
এ সময় নোবেলের কাছে জানতে চাওয়া হয় একটি সময় তার সঙ্গে দেশের ব্যান্ড সংগীতের জীবন্ত কিংবদন্তি নগর বাউল জেমসের সঙ্গে তুলনা করা হতো। সেই তুলনা কী তার ক্যারিয়ারের জন্য উপকার হয়েছিল নাকি ক্ষতি? উত্তরে নোবেল বলেন, ‘বাংলায় একটা প্রবাদ রয়েছে, লাই দিয়ে মাথায় তুলে দেওয়া। আমার এমনটাই হয়েছিল। রিয়্যালিটি শো আমাকে তারকাখ্যাতি এনে দেয়। এরপর আমার ভক্তরা আমাকে ভালোবাসা দিয়ে মাথায় তুলে দেয়। এ বিষয়ে আমি তাদের দোষ দিচ্ছি না, কিন্তু আমি বিষয়টি উপভোগ করে নিজেকে তখন হারিয়ে ফেলি। এরপর পরে বুঝতে পারি, জেমস ভাইয়ের সঙ্গে তুলনাই আমাকে সেসময় শেষ করে দিয়েছিল। কারণ জেমস ভাই ভিন্ন বিষয়। তিনি দেশের ব্যান্ড সংগীতের একটি স্তম্ভ। আমি কেন—বিশ্বের কেউই সংগীতে তার সমতুল্য হতে পারবেন না। গানে তার আলাদা দর্শন রয়েছে। সেই দর্শনের সঙ্গে কারোরই মিলবে না। এ ছাড়া জেমস ভাই এখন পর্যন্ত শতশত গান গেয়েছেন। মৌলিক গানের দিক থেকে আমি তার ধারে কাছেও নেই। অর্জনের সব দিক থেকেই তিনি আমাদের থেকে শত শত মাইল দূরে। তাই শ্রোতাদের একটা কথাই বলব। যারা আমার গান পছন্দ করেন, তারা আমাকে কারও সঙ্গে তুলনা করবেন না প্লিজ। কারণ সংগীতে আইয়ুব বাচ্চু, এন্ড্রু কিশোর ও আসিফ আকবর ভাইদের অর্জন আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। কেউই জীবনভর চাইলেও তাদের মতো হতে পারবে না।’
বর্তমানে নোবেলের হাতে বেশকিছু গান ও দুটি সিনেমা রয়েছে, যা ওটিটি প্ল্যাটফর্মের জন্য নির্মাণ হবে। যেখানে একটিতে ভিলেন চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা যাবে তাকে। কারণ ভিলেন চরিত্র নিয়েই ফিরতে চান এই গায়ক। এ বিষয়ে নোবেল আরও বলেন, ‘আমার ইতিহাসের প্রতি একটা দুর্বলতা আছে। আমি অনেক ডকুমেন্টারি দেখি। তো এসব ডকুমেন্টটি থেকে আমি একটি বিষয় নিশ্চিত যে, পরাজিত মানুষগুলোই সবসময় ভিলেন হয়ে যায়। আর জয়ীরা সবসময়ই নায়ক হয়। সেই জায়গা থেকে আমার ভিলেন চরিত্রের প্রতি আলাদা ভালো লাগা রয়েছে। তাই নতুন একটি সিনেমায় চুক্তিবদ্ধ হয়েছি। সেখানে দর্শক আমাকে ভিলেন রূপে দেখবেন। কারণ এই ভিলেনের চরিত্রটি আমার জীবনের সঙ্গেও সম্পৃক্ত। এ বিষয়ে বিস্তারিত এখনই বলতে পারছি না। তবে কাজটি ভালো হবে এ বিষয়ে দর্শকদের আমি নিশ্চিত করতে পারি।’নোবেল এখন পর্যন্ত বেশ কয়েকটি নিজের মৌলিক গান প্রকাশ করেছেন। তার মধ্যে ‘অভিনয়’, ‘তোমার মনের ভেতর’, ‘মেহেরবান’ ও ‘অপরাধ’ উল্লেখযোগ্য। শিল্পীর এমন ফিরে আসার খবরে এরই মধ্যে শ্রোতাদের মাঝে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।