দুর্নীতি ও অব্যবস্থা প্রশাসন থেকে দিক বদল করে দেশের আর্থিক খাতে কেন্দ্রীভূত হয়েছে। ঋণ অনিয়মে অভিযুক্ত হচ্ছে একের পর এক ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান। একটি দুর্নীতিকাণ্ডের রেশ কাটতে না কাটতে অন্য প্রতিষ্ঠানের বিপুল অর্থের কেলেঙ্কারির তথ্য বেরিয়ে আসছে। যারা এসব অনিষ্টের হোতা তাদের অনেককে বিচারের আওতায় আনা এখনো সম্ভব হয়নি। দেশের বিচারকরাও অবাক হয়ে যাচ্ছেন রক্ষকের ভক্ষক হওয়ার এসব কুদৃষ্টান্ত দেখে। অনিষ্টকারীরা দারুণ চালু। তারা আগেভাগে আগাম জামিনে মরিয়া হয়ে উঠছেন। সম্প্রতি এ রকমই এক দুর্নীতি মামলায় হাইকোর্ট বলেছেন, ‘ব্যাংকসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বড় ধরনের দুর্নীতির অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। এসব আর্থিক অপরাধ দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে দেশ এগিয়ে যাবে কিভাবে?’
ব্যাংকগুলো কার্যকর কোনো কিছু করতে পারছে না বা করছে না এবং বাংলাদেশ ব্যাংকও কার্যকর কিছু করতে পারছে না বা করছে না। এ তো চলছে পুরো অর্থ খাতে। এত কিছুর জন্য বিশেষ বিচার হয়, ঋণখেলাপি বা অর্থ জালিয়াতির বিচারে ‘স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল’ করতে বাধা কোথায়?
মহামান্য হাইকোর্টের মন্তব্য প্রসঙ্গে পত্রিকায় প্রকাশিত খবর মোতাবেক, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কৌঁসুলি বলেন, ‘হাইকোর্ট যথার্থই বলেছেন। কারণ দুর্নীতি মামলার অনুসন্ধান, তদন্ত ও বিচার করতে গিয়ে ‘দুদক’ দেখতে পাচ্ছে যে, ব্যাংকিং ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম বাংলাদেশ ব্যাংক ভালোভাবে ‘মনিটর’ করতে পারছে না। এটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সক্ষমতার অভাব। তেমনি বাংলাদেশ ব্যাংককে ঠিকমতো ‘মনিটর’ করতে পারছে না সরকারের আর্থিক বিভাগ। কাজেই এ বিষয়টি মাথায় নিয়েই এখন থেকে আর্থিক বিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংককে অনেক বেশি সতর্ক হতে হবে।
আগে আমরা শুনতাম বা খবরের কাগজে পড়তাম ব্যাংক লুটের কাহিনী। অর্থাৎ ব্যাংকের কোনো শাখা ভেঙে টাকা লুট হওয়ার কাহিনী। কিন্তু ব্যাংক নিজেই যখন তার কাছে রক্ষিত জনগণের আমানত কতিপয় পরিচালক বা কর্মকর্তার যোগসাজশে লুট বা তছরুপ করেন তাকে তখন কী বলবেন? তবে কি ‘ব্যাংক লুট’ বিষয়টি প্রমোশন পেয়ে ব্যাংক মালিকদের লুটপাটে উত্তরণ ঘটেছে? অর্থাৎ রক্ষকই হয়ে গেছে ভক্ষক? কেলেঙ্কারি কি একটি-দু’টি হয়েছে? হলমার্ক, বেসিক ব্যাংক, ফার্মার্স ব্যাংক, রিলায়েন্স ফাইন্যান্স, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, পিপলস লিজিংসহ আরো অনেক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে একুনে হাজার হাজার কোটি টাকার অব্যবস্থাপনা হয়েছে। এসব দুর্নীতি, দুরাচার নিয়ে একের পর এক মামলা ঠুকেছে দুর্নীতি দমন কমিশন। মামলার তদন্ত চলছে কয়েকটির। অনেকগুলো মামলার তদন্তানুষ্ঠান এখনো শুরু হয়নি। মাননীয় আদালতে কয়েকটির মামলায় ঋণ কেলেঙ্কারিতে জড়িত ঊর্ধ্বতন ব্যাংক কর্মকর্তাদের সাজাও দিয়েছেন। কিন্তু তাতে কি বন্ধ হয়েছে পরবর্তী কেলেঙ্কারি? থেমেছে কি ব্যাংক লুটপাটের ঘটনা?
হাইকোর্ট যথেষ্ট বিরক্ত এবং ক্ষুব্ধ প্রতিকারহীন এসব ব্যাংক জালিয়াতির ঘটনায়। দেশের আর্থিক অব্যবস্থাপনা ও জাতীয় অর্থনীতিতে এর অনিবার্য প্রতিক্রিয়ার কথা ভেবে বিচারালয়ের এমন দুঃখবোধ অত্যন্ত স্বাভাবিক। এরকমই এক মামলায় আদালত অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন, ‘জালকার্যাদেশ এবং অবৈধ ব্যাংক গ্যারান্টির মাধ্যমে বিপুল অর্থ আত্মসাৎ করেছে আসামিরা। এ ধরনের দুর্নীতিবাজদের কোনো ধরনের ছাড় দেয়া হবে না। আমরা আগেও ছাড় দেইনি, এখনো দেবো না।’ আদালতের এই উপলব্ধির মধ্যেই ফুটে উঠেছে দেশের আর্থিক খাতে চলমান নৈরাজ্যকর অবস্থার বাস্তব চিত্র। অপর একটি মামলায় মাননীয় হাইকোর্ট যথার্থই বলেছিলেন, ‘নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান বানিয়ে ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। বড় লোক হওয়ার এতই উচ্চাকাক্সক্ষা!’
মানুষের শেষ আশা-ভরসার আশ্রয়স্থল আদালত। এই আদালতই লাগাতার ব্যাংক জালিয়াতির প্রবণতায় উদ্বিগ্ন। পর্যবেক্ষক মহল সেই আদালতই মনে করেন, কেবল দুদকের অভিযোগের জন্য অপেক্ষায় না থেকে আদালতেরও উচিত হবে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বড় বড় ব্যাংক জালিয়াত ও ‘ক্রনিক’ ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া। কারণ আদালতের সে ক্ষমতা রয়েছে। আদালতের অভিমত যথাবিহিত গুরুত্বের সাথে আমলে নিতে হবে অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংককে। অনেক হয়েছে, আর নয়। ব্যাংক বানিয়ে কেউ যদি ভাবে, জনগণের আমানত তাদের পৈতৃক সম্পত্তি হয়ে গেছে তাহলে বুঝিয়ে দিতে হবে যে, তারা বোকার স্বর্গে বাস করছে। আর দশটি অপরাধের বেলায় যা হয় ব্যাংক জালিয়াতির ক্ষেত্রে বিচারের প্রক্রিয়া একই গতিতে চলতে হবে। বলা চলে, তার চেয়েও কঠোরতা অবলম্বন করতে হবে। কেননা, তারা দেশের মানুষের আমানত নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবর : সাত বছর ধরে ঝুলছে বেসিক ব্যাংকের চার হাজার কোটি টাকা লোপাটের ঘটনাসহ অনুরূপ ৫৬টি ব্যাংকঋণ জালিয়াতির মামলা। ওই খবরে বলা হয়, বেসিক ব্যাংকের আর্থিক কেলেঙ্কারির মামলা তদন্তে হাইকোর্টের নির্দেশনাকেও আমলে নিতে চাইছে না দুর্নীতি দমন কমিশন। অথচ বিভিন্ন সময়ে আসামিদের জামিন আদেশ পর্যালোচনাকালে হাইকোর্ট দ্রুত মামলার তদন্ত শেষ করার নির্দেশ দিয়েছেন। আইনের বিধান মোতাবেক ১৮০ দিনের মধ্যে মামলার তদন্তকাজ শেষ করার কথা থাকলেও সাত বছর ধরে ঝুলছে এরকম ৫৬টি মামলার তদন্ত। ওই মামলাগুলোরও তদন্তে দৃশ্যত তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। অন্যান্য দেশে আর্থিক খাতে দুর্নীতি বা প্রাতিষ্ঠানিক জালিয়াতির দ্রুত বিচার সম্পন্ন হয়ে থাকে এবং এগুলো একেকটি নজির হিসেবে স্থাপিত হয়। একটি বার অনেক সম্ভাব্য প্রতারণার সাথে জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে।
এই যে দেশে অকস্মাৎ ডলার নিয়ে একটি নৈরাজ্যকর অবস্থা সৃষ্টি হলো এবং অবিরামভাবে টাকার বিপরীতে ডলার মাঙ্গা হয়ে উঠছে, অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙে দিতে চলেছে, অবাধে তা চলছে প্রতিকারহীনভাবে। বড় বড় ব্যাংকগুলো একই দিনে একাধিক বিনিময় হারে ডলার ছাড়ছে, আমদানিকারকরা পথে বসতে চলেছে এবং উচ্চহারে ডলার কিনে পণ্য এনে জনগণের জন্য বোঝার উপর শাকের আঁটি চাপাচ্ছে, এগুলো কি আর্থিক খাতে দণ্ডযোগ্য অপরাধ নয়? মাঝে মধ্যে ব্যাংকগুলোর কাজ কারবার দেখে মনে হয়, দেশে কোনো কেন্দ্রীয় ব্যাংক নেই। থাকলেও তার কোনো শাসন-অনুশাসন কেউ মানছে না বা গ্রাহ্যের মধ্যে আনছে না। ব্যাংক হয়তো দুষবে অর্থ মন্ত্রণালয়কে, আর্থিক ব্যবস্থাপনাকে। এই দোষারোপের খেলায় প্রাণ যাবে আমদানিকারকদের বা তাদের আনা পণ্য ব্যবহারকারী ভোক্তা জনগোষ্ঠীকে, যারা এসব অব্যবস্থাপনার অসহায় শিকার। অপরাধীরা সংঘবদ্ধ, অথচ ভোক্তা সাধারণ অসংগঠিত, নেতৃত্বহীন। বণিক ও শিল্প চেম্বারগুলো রুটিন মাফিক বাদ-প্রতিবাদ করেই চলেছে, টেলিভিশনে আলোচনা সভায় বক্তারা বলেই চলেছেন, পণ্ডিত কলামিস্টরা পত্রিকার কলাম ভরেই চলেছেন, কোনো কিছুতে দৌরাত্ম্য ও দুর্বৃত্তায়নের বিষক্রিয়া থেকে আর্থিক খাতের বিমারকে আরোগ্য করাই যাচ্ছে না।
প্রতিকারহীন দুর্নীতি এবং প্রতিরোধহীন অনিয়ম-অনাচারের উপজাত হয়ে অর্থনীতির রুগ্ণ দেহে হামলা করছে স্বেচ্ছাধীন ঋণখেলাপি এবং অর্থ পাচারকারীরা, আর এসব চক্রের সাথে অনেক ব্যাংক উদ্যোক্তা পরিচালক বা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের যোগসাজশ থাকারও অজস্র অভিযোগ রয়েছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি সরকারি ব্যাংকগুলোও অব্যবস্থার গুরুতর অভিযোগের বাইরে থাকছে না। সব মিলে এটি এখন একটি ‘দুষ্টচক্রের’ মতো কৃষ্ণ সংঘে পরিণত হয়েছে। তারই প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে মাননীয় উচ্চ আদালতের অন্তর্জ্বালায় জর্জরিত পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়নে।
অনেক ক্ষেত্রে দুর্নীতিকে কতটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিতেও দেখা যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গত মার্চ মাস পর্যন্ত হালনাগাদকৃত প্রতিবেদনে ফুটে উঠেছে, গত মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত আটটি ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়ায় ২০ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা। কয়েকটি ব্যাংক ব্যাপক অঙ্কের মূলধন ঘাটতি নিয়ে চলেছে। অনেক ব্যাংকের ঋণখেলাপিরা ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ না করে বিদেশে নিরাপত্তা তালাশ করছেন। অনেকে পরিবারকেও বিদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। ব্যাংকের দেনা পরিশোধের ধারে কাছেও যাচ্ছেন না অনেকে। এদিকে সুদাসল অনাদায়ী থাকায় সুদের হার কেবল স্ফীতই হচ্ছে। এভাবে অনেক সুদ প্রিন্সিপ্যাল অ্যামাউন্টকেও অতিক্রম করে যাচ্ছে। ব্যাংকগুলো কার্যকর কোনো কিছু করতে পারছে না বা করছে না এবং বাংলাদেশ ব্যাংকও কার্যকর কিছু করতে পারছে না বা করছে না। এই তো চলছে সারা অর্থ খাতে। এত কিছুর জন্য বিশেষ বিচার হয়, ঋণখেলাপি বা অর্থ জালিয়াতির বিচারে ‘স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল’ করতে বাধা কোথায়?