প্রশ্ন উঠেছে ব্যয় আর কার্যকারিতা নিয়ে; গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং নিয়েও আপত্তি আছে।
ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরে যে থার্ড টার্মিনাল চালুর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে ‘যোগাযোগের নতুন যুগের সূচনা হবে’ বলা হচ্ছিল বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে, সেই টার্মিনালের ব্যয় নিয়ে এখন প্রশ্ন উঠছে, সন্দেহ দেখা দিয়েছে কার্যকারিতা নিয়েও।
এখন অভিযোগ উঠছে, কয়েকগুণ বেশি খরচ করেও ‘নিম্নমানের সামগ্রী’ বসানো হয়েছে এ টার্মিনালের নির্মাণ কাজে। একটিমাত্র রানওয়েতে এখনি উড়োজাহাজের উড্ডয়ন ও অবতরণের ক্ষেত্রে ১০ থেকে ২৫ মিনিট পর্যন্ত জট পড়ছে। সেখানে আরেকটি রানওয়ে তৈরি না করে শুধুমাত্র টার্মিনাল ভবনের ওপর ভিত্তি করে সেবা কতখানি বাড়ানো যাবে, সে প্রশ্নও রয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং নিয়েও। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আশপাশের দেশগুলোর থেকে কয়েকগুণ বেশি টাকা দিয়েও কাঙ্ক্ষিত সেবা মিলছে না। সে কারণে প্রতিটি এয়ারলাইন্স বিমানবন্দরে নিজেদের লোক নিয়োগ দিয়ে কাজ চালাচ্ছে। তাতে খরচ বাড়ছে যাত্রীদের।
সোমবার রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে একত্রিত হয়েছিলেন দেশের সিভিল এভিয়েশন অথরিটি, দেশি-বিদেশি এয়ারলাইন্সের মালিক ও প্রতিনিধি, বিমানের প্রতিনিধি, কার্গো সেবাদানকারীসহ এই খাত সংশ্লিষ্ট প্রায় সবগুলো সংস্থার প্রতিনিধিরা। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ‘তৃতীয় টার্মিনাল: সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে এভিয়েশন ও পর্যটন খাতের রিপোর্টারদের সংগঠন এটিজেএফবি।
বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করে দেশীয় মালিকানাধীন বেসরকারি এয়ারলাইন্সগুলোর সংগঠন এওবির সেক্রেটারি জেনারেল ও নভোএয়ার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মফিজুর রহমান। তিনি প্রথমেই প্রশ্ন রাখেন, প্রাথমিকভাবে একটি সমান্তরাল রানওয়েসহ থার্ড টার্মিনাল প্রজেক্টে সাত হাজার কোটি টাকার প্রাক্কলিত ব্যয় কীভাবে মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে রানওয়ে বাদ দিয়েই ২২ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়াতে পারে?
তিনি বলেন, “গাড়ি পার্কিং ছাড়াই ২০১৬ সালের দিকে থার্ড টার্মিনালের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়। বিমানের বলাকা বিল্ডিং ভেঙে অথবা ভূগর্ভস্থভাবে পার্কিং পরিকল্পনা নেওয়া ছিল যুক্তিযুক্ত। যখনই বিমানের প্রশ্ন আসে, তখনই সামষ্টিক স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে এমন পদক্ষেপ নেওয়া হয়, যার দীর্ঘস্থায়ী কুফল জাতিকে ভোগ করতে হয়। বিমান হেড অফিস খুব সহজেই তিন একর জায়গার ওপর স্থাপিত প্রশাসনিক বিল্ডিং এর পাশে পুনঃনির্মাণ করা যেত অথবা সামিট গ্রুপকে হোটেল তৈরির জন্য দেওয়া ১৫ একর জমির একাংশে স্থাপনা করা যেত।”
বর্তমান বিমান বন্দরের প্রবেশমুখে নতুন একটি শপিংমল করা হয়েছে, যেখানে হোটেল করার কথা ছিল জানিয়ে মফিজুর রহমান বলেন, “এতে বিমানবন্দরের মূল প্রবেশ পথে ভবিষ্যতে যে অসহনীয় যানজটের সৃষ্টি হবে সে কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।”
ঢাকার থার্ড টার্মিনালের সঙ্গে একই সময়ে কাজ শুরু হওয়া বেঙ্গালুরুর ক্যাম্পাগাউড়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ২০২২ সালেই চালু হয়েছে, সে কথা তুলে ধরে মফিজুর রহমান বলছেন, কোন রকম ব্যয়বৃদ্ধি ছাড়াই ওই বিমানবন্দর তৈরিতে পাঁচ হাজার কোটি রুপি খরচ হয়েছে, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় সাত হাজার কোটি টাকা। ওই বিমানবন্দরটি আয়তনে ঢাকার থার্ডি টার্মিনালের চেয়ে ২৩ শতাংশ বড়।
২০১৭ সালে থার্ড টার্মিনাল নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেয় তখনকার আওয়ামী লীগ সরকার। নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর। ব্যয় ধরা হয় প্রায় ২১ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা।
গত বছরের ৭ অক্টোবর থার্ড টার্মিনালের আংশিক উদ্বোধন করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেসময় বেবিচক জানিয়েছিল, ২০২৪ সালেই পুরোপুরি কার্যক্রম শুরু হবে থার্ড টার্মিনালের। কিন্তু তা আর হয়নি।
এত খরচের পরও সেখানে ‘নিম্নমানের অচেনা ব্রান্ডের যন্ত্রপাতি’ বসানো হয়েছে অভিযোগ করে মফিজুর রহমান বলেন, “হাজারটা প্রশ্নবোধক চিহ্নের মাঝে বিরাট আয়োজনে আর ঢাকঢোল পিটিয়ে নির্মাণ শেষ হবার অনেক আগেই শুধুমাত্র রাজনৈতিক স্ট্যান্টবাজি আর নির্বাচনের মাঠে ফায়দা লোটার জন্য বিগত সরকার থার্ড টার্মিনালের উদ্বোধন করে।”
আলোচনার প্রধান বক্তা বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ বলেন, “থার্ড টার্মিনালে খরচের বিষয়টা আসছে। কি নোট পেপারের মধ্যেই প্রশ্নটি তোলা হয়েছে যে দুর্নীতি না হলে এতো খরচ হত না। এই বিষয়গুলো আমরা খতিয়ে দেখব।
“যেহেতু সব ক্ষেত্রেই সংস্কারের একটি বিষয় আসছে। প্রত্যেকটি বিষয় এই ফোকসের মধ্যে আসবে। সেভাবে এভিয়েশন নিয়েও একটা শ্বেতপত্র আসতে পারে। শ্বেতপত্র মানে শুধু অভিযোগের আঙুল নয়, বরং আমার আত্মশুদ্ধির একটা পদক্ষেপ।”
‘লুটপাটের’ কথা বলতে গিয়ে মফিজুর রহমান বলেন, “আজকে থার্ড টার্মিনাল যে ভূমির উপর দাঁড়িয়ে আছে, ১৪৫ একরের সেই জমিটি আইপিসিও নামে এক ভূঁইফোর কোম্পানিকে নাম মাত্র মূল্যে ৬০ বছরের জন্য লিজ দেওয়া হয়। সিঙ্গাপুরে নিবন্ধিত এই কোম্পানির নেপথ্যে যে বাংলাদেশি কোন গোষ্ঠী সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
“ফারুক খান যখন বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রী, সে সময় তার পারিবারিক প্রতিষ্ঠান সামিট গ্রুপকে ১৫ একরের ওপর মহামূল্যবান এই সম্পত্তির একটি অংশ হস্তান্তর করা হয়। এখানে স্বার্থের সংঘাত সুস্পষ্ট। কাগজে কলমে এই ভূমি এখন ইউনাইটেড গ্রুপের।”এ বিষয়ে সাংবাদিকদের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরির আহ্বান জানান তিনি। তার এ অভিযোগের বিষয়ে সামিট গ্রুপের বক্তব্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম জানতে পারেনি।
গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং
পুরো আলোচনার উল্লেখযোগ্য সময় শাহজালালের দুটো টার্মিনালে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সেবা দিয়ে আসা বিমানের সেবা নিয়ে সমালোচনা করেন সংশ্লিষ্টরা। থার্ড টার্মিনালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের কাজ সরকার বিমানকে দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেন কেউ কেউ।
রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স গত ৫৪ বছর ধরেই ঢাকা বিমানবন্দরে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সেবা দিয়ে আসছে। এয়ারলাইন্সগুলোর সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী যাত্রীদের ক্ষেত্রে চেক-ইন, বোর্ডিং পাস দেওয়া থেকে শুরু করে, উড়োজাহাজে যাত্রী ওঠা-নামার জন্য সিঁড়ি বা বোর্ডিং ব্রিজের ব্যবস্থা করা, যাত্রীদের ব্যাগেজ নামানো-ওঠানো, উড়োজাহাজটি টার্মাক থেকে ট্যাক্সিওয়েতে ঠেলে নিয়ে যাওয়া এসবই গ্রাউন্ড হ্যান্ডলারের কাজ।
কার্গোর ক্ষেত্রে কার্গো বুঝে নিয়ে উড়োজাহাজে উঠিয়ে দেওয়ার কথা গ্রাউন্ড হ্যান্ডলারের। কিন্তু বিমান তার কিছুই করে না বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।
মূল প্রবন্ধে মফিজুর রহমান বলেন, “সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে বিমানের জিম্মায় থার্ড টার্মিনালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সেবা দুই বছরের জন্য প্রদানের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে জোর বিতর্ক চলমান এবং তা যৌক্তিক।”
তিনি একাধিক কোম্পানিকে প্রতিযোগিতার সুযোগ দেওয়ার আহ্বান জানান।
আলোচনা পর্বে এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ ও বিমান পরিচালনা বোর্ডের সাবেক সদস্য কাজী ওয়াহিদুল আলমও গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং নিয়ে কথা বলেন।
শত বিতর্কের পরও বিমানের হাতে এ কাজ রাখার সমালোচনা করে তিনি বলেন, “আমাদের মত এরকম মনোপলি গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সিস্টেম পৃথিবীর আর কোথাও নেই। গত ৫৪ বছরে বিমান পারেনি। আগামী দুই বছরে বিমান কতটুকু পারবে আমাদের বড় সন্দেহ আছে। তাদের প্রতিযোগী থাকতে হবে। এয়ারলাইন্সগুলো পয়সা দিচ্ছে, যাত্রীদের কাছ থেকে নিয়ে। যাত্রীরা যদি জানত তাদের কাছ থেকে পয়সা নিয়েও সেবা দিচ্ছে না তাহলে অনেক কিছু হত।”
এয়ারলাইন্স অপারেটরস কমিটির (এওসি) ঢাকার চেয়ারপারসন দিলারা হোসেন বলেন, “শাহজালাল বিমানবন্দরে আজ থেকে ৩০-৪০ বছর আগে যেসব অভিযোগ শুনেছি এখনো একই ধরনের অভিযোগ আসছে। এই বিমানবন্দরে ক্রমেই বিদেশি এয়ারলাইন্স বাড়ছে। কিন্তু গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং এর সেবার মান বাড়ছে না। সেই একই অভিযোগগুলোর সমাধান হয়নি এতদিনেও।”
এ বিষয়ে উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ আলোচনায় বলেন, “যেটা সকলেরই উদ্বেগের বিষয়, যে এতবড় একটা কর্মযজ্ঞে বিমানের দক্ষতা ও সক্ষমতা আছে কী নেই। যার কারণ আমরা এতোদিন বিমানের যে সার্ভিসটা পেয়ে আসছি সেটা যে লেবেলের হওয়া উচিৎ ছিল সেই লেভেলের না। আমরা এসব নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। প্রত্যেকদিনই আমরা সক্ষমতা বৃদ্ধির বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বা নিতে হবে সেগুলো আমরা আলোচনা করছি।”
গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং নিয়ে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার সুযোগ আছে কি না জানতে চাইলে উপদেষ্টা বলেন, “আজ প্রশ্ন নেব না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে সক্ষমতা বৃদ্ধির, সেটা আমরা দেখছি। আমরা এই দুই বছর যে গালে হাত দিয়ে বসে থাকব, আর বলব হায় হায় কী হল– বিষয়টি এমন নয়। যদি তাদের (বিমান) সক্ষমতার ঘাটতি হয়, তাহলে আমরা বিকল্প ব্যবস্থা নেব। এটা ক্লোজ এন্ডেড না, ওপেন এন্ডেড।”
“কক্সবাজার এয়ারপোর্ট: কমপ্লিট ডিজাস্টার”
আলোচনায় অংশ নিয়ে এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ ওয়াহিদুল আলম বলেন, “থার্ড টার্মিনাল আমরা করেছি। কিন্তু এখন এয়ারপোর্ট থেকে বনানী যেতে তিন ঘণ্টা লাগে কখনো। ইজতেমার সময় যাত্রীদের এয়ারপোর্টে পৌঁছাতে কী যুদ্ধ করতে হয়।
“এখানে ৩০ হাজার কোটি টাকা খরচ করে টার্মিনাল বানানো হলো এটা কতটুকু কাজে লাগবে সেই সন্দেহ আছে আমার। হয়ত যাত্রীদের একটু আরাম হবে, দেখতে সুন্দর একটা টার্মিনাল আমরা পেয়েছি। কিন্তু অপারেশনাল হ্যাজার্ডগুলো কিছুতেই কমছে না।”
তিনি বলেন, “একটা রানওয়ে নিয়ে শুধু টার্মিনাল করে একটা এয়ারপোর্টকে জাস্টিফাই করা যাবে না। এখনি উড়োজাহাজগুলোকে ২০-২৫ মিনিট করে কিউতে (অপেক্ষমাণ) থাকতে হয়। প্রতিনিয়ত যাত্রী বাড়ছে, কার্গো বাড়ছে। কাজেই এই জায়গায় বিমানবন্দর রেখে কখনোই ‘এভিয়েশন হাব’ হওয়ার স্বপ্ন দেখা যাবে না।”
বিগত আওয়ামী লীগ সরকার ১ হাজার ৫৬৮ দশমিক ৮৬ কোটি টাকায় কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণের যে প্রকল্প শুরু করেছিল তাকে ‘কমপ্লিট ডিজাস্টার’ আখ্যা দিয়ে ওয়াহিদুল আলম বলছেন, “এখনো চট্টগ্রাম যথাযথ আন্তর্জাতিক মানের হয়নি। সেখানে দুই-একটি বিদেশি এয়ারলাইন্স এসেও ফিরে গেছে। কারণ ওখানে ফল্টি সিস্টেম। ওদের রানওয়েটা ফল্টি, ট্যাক্সিওয়ে নাই। টার্মিনালে সুযোগ-সুবিধা নাই।
“চট্টগ্রামকে উন্নত না করে আমরা কক্সবাজারের নিচু জমিতে কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচ করে একটা এয়ারপোর্ট বানালাম। ওই এয়ারপোর্টটা কী কাজে আসবে আমাদের? ওখানে বিদেশি ট্যুরিস্টরা প্লেনভরে এস নামবে এমন আশা করা অলীক স্বপ্ন। ওটা আমাদের কোনো কাজে আসবে না, ওটা একটা কমপ্লিট ডিজাস্টার।”
বিমান পরিচালনা বোর্ডের সাবেক এই সদস্যের ভাষায়, গত ৫৪ বছরে বাংলাদেশ সিভিল এভিয়েশনের অর্জন ‘শূন্য’।
“এ সময়ের মধ্যে একটা রানওয়ে হয়নি, কিছুই হয়নি। নতুন একটা রানওয়ে, একটা নতুন গন্তব্য দিতে পরিনি আমরা। পুরনো অনেকগুলো আরও বন্ধ হয়েছে।”
ওয়াহিদুল আলম যখন এ কথা বলছিলেন, সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যান মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া তার ঠিক পাশেই বসা ছিলেন।
“কার্গোর কথা কেউ শোনে না”
আলোচনায় অংশ নিয়ে শাহজালালের কার্গো ব্যবস্থাপনা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন কাতার এয়ারওয়েজের কার্গো ম্যানেজার সুহেদ আহমেদ চৌধুরী।
তিনি বলেন, “আমাদের কার্গোর কথাবার্তা কেউ শুনেন না। কার্গোতে আমাদের মালামালগুলো কার্গো ভিলেজ থেকে নিয়ে উড়োজাহাজের ভেতরে ঠিক জায়গায় বসিয়ে দিয়ে আসতে হয়। এজন্য যাত্রীর চাইতে কার্গোতে লোকজন লাগে অনেক বেশি। কার্গো টার্মিনালে কাজ করার কোনো পরিবেশই নাই। এখানে কোনো অবকাঠামোই নাই।
“আমাদের যে ওয়্যারহাউজটা আছে, সেটা ২০ বছর আগে তৈরি। এর মধ্যে রপ্তানি বেড়েছে তিনশ শতাংশ। কিন্তু এর চার দেয়ালের পরিধি বাড়েনি। এখানে প্রতি মাসে ২৫ হাজার টন রপ্তানি করি আমরা।”
ইউরোপে যে কোনো পণ্য রপ্তানির আগে একটি বিশেষ আরএ থ্রি মডেলের এক্সরে বা ইডিএস যন্ত্র দিয়ে স্ক্যান করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ঢাকা বিমানবন্দরে মাত্র দুটো ইডিএস মেশিন দিয়ে এই কাজ করতে অনেক বেশি সময় লাগছে জানিয়ে কাতার এয়ারের এই কর্মকর্তা বলেন, “মোট চারটা মেশিন বসানো হয়েছিল, দুটো জন্ম থেকেই আইসিইউতে। এসবের কারণে ব্যবসা চলে যাচ্ছে আশপাশের দেশে।
“এখন প্রতিদিন এক টনের বেশি কার্গো চলে যাচ্ছে দিল্লিতে, কলকাতায়। ট্রাক দিয়ে সেখানে নিয়ে এয়ারে উঠছে কার্গো। এসব কারণে এখানে বড় কোন কার্গো এয়ারলাইন্স আসতে চায় না। ঢাকায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা এয়ারপোর্টে বসে থাকতে হয়। আর ওদিকে গ্রাউন্ড টাইমিং চার্জ বাড়তে থাকে। ঢাকায় এই চার্জও অনেক বেশি।”
তিনি বলেন, “বাংলাদেশে একটা কার্গো ফ্লাইট অপারেট করতে ২০ হাজার ডলারের বেশি চার্জ দিতে হয়। আমাদের গ্রাহকদের সেই চার্জ বহন করতে হচ্ছে। আল্টিমেটলি অনেক কাস্টমার ইন্ডিয়ায় চলে যাচ্ছে। আমরা ৩০ হাজার কোটি টাকা খরচ করে থার্ড টার্মিনাল করলাম, কিন্তু মাত্র ২৫ কোটি টাকা খরচ করে দুটো ইডিএস মেশিন বসানো হচ্ছে না “
রাখার জায়গা না থাকায় রোদ-বৃষ্টিতে প্রচুর মালামাল নষ্ট হচ্ছে জানিয়ে সুহেদ আহমেদ বলেন, “আমাদের এখানে আসা কন্টেইনারগুলো নষ্ট হচ্ছে। বৃষ্টির সময় কাগজের কার্টনগুলো ভিজে নষ্ট হয়ে যায়। রাখার জায়গা নেই। মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার আমরা ক্ষতিপূরণের দাবির মোকাবেলা করছি। এগুলো কে ভরবে বলেন?“
গ্রাউন্ড হ্যান্ডলার বিমানকে পয়সা দিয়েও সেবা না পাওয়ার আক্ষেপ জানিয়ে সুহেদ বলেন, “এখানে আমরা ৮২ জন স্টাফ রাখতে হয়। অথচ পুরো কাজটা করার কথা গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলার বিমানের। তারা পয়সা নিয়েও সেবা দিচ্ছে না। এখন আমাদের কোনো দাবি নেই। আমরা শুধু চাই গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের জন্য বিমানের সঙ্গে আমাদের যে চুক্তি হয়েছে, তারা সেটা অক্ষরে অক্ষরে পালন করুক।”
যা বলছেন সেবাদাতা ও কর্তৃপক্ষ
বৈঠকে সবার অভিযোগ শুনে সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া বলেন, “একজন বলেছেন আমরা কিছুই না, ‘জিরো’। কিন্তু তবুও আমি এখানে দাঁড়িয়ে আছি, কথা বলছি। মনে হয় আমরা ফিনিক্স পাখি, ছাই থেকে উঠে এসেছি। আমরা আরও ওপরে যাবো ইনশাল্লাহ। এটা আমাদের অঙ্গীকার।
“এখানে অনেকগুলো বিষয় এসেছে। আমরা সেগুলো আমলে নিচ্ছি। আমি একটা একটা করে কথা বলতে চাই না। কার্গো নিয়ে বলতে চাই, থার্ড টার্মিনালে এর জন্য দারুণ ব্যবস্থা আছে, সব স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতি রয়েছে। তবে যন্ত্রের পেছনের মানুষগুলো একটা ফ্যাক্টর। এজন্য আমরা বিমানকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছি।”
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পরিচালক (কাস্টমার সার্ভিস) হায়াত-উদ-দৌলা খাঁন একটি পাওয়ার পয়েন্ট উপস্থাপনা দেখান। বর্তমানে বিমানবন্দরের দুইটি টার্মিনাল পরিচালনায় বিমানের কিছু সমস্যা রয়েছে স্বীকার করে তিনি বলেন, “চেক-ইন এ যে জনবল দরকার তা আমরা দিতে পারি না। আমরা কিছু ইকুইপমেন্টের শর্টে আছি। ২০১৪-১৫ সালে এই বিমানবন্দরে বছরে ৬ মিলিয়ন যাত্রী চলাচল করত, এখন যাত্রী বেড়েছে। ২০২৪ সালে এটি ১০ মিলিয়নের কাছাকাছি চলে এসেছে।
“যাত্রী ও ফ্লাইট সংখ্যা বাড়লে আগের ইকুইপমেন্ট ও ম্যানপাওয়ার দিয়ে আমরা সবসময় ভালোভাবে যাত্রী সার্ভিস দিতে পারি না। পৃথিবীতে আধুনিক টার্মিনাল এটি (থার্ড টার্মিনাল)। সব ধরনের ফ্যাসিলিটিস এখানে আছে। আমরা এয়ার লাইন্সগুলোর সঙ্গে একাধিকবার বসব। আশা করছি থার্ড টার্মিনালে আমরা সবাইকে কাঙ্ক্ষিত সার্ভিস দিতে পারব।”
তিনি বলেন, “বিমান শাহজালালের তৃতীয় টার্মিনালে দুই বছরের জন্য গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সার্ভিস দিতে চায়। এই সার্ভিস যদি প্রত্যাশা অনুযায়ী না দিতে পারে তাহলে অন্য কাউকে এই দায়িত্ব দেওয়া হবে। সরকারের এই সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে বিমানের সক্ষমতা জানাতে ১ ডিসেম্বর থার্ড টার্মিনালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং অ্যাক্টিভিটি পর্যালোচনার জন্য ম্যান পাওয়ার, ইকুইপমেন্ট, ট্রেনিংসহ ডিটেইল অ্যাকশন প্ল্যান দেওয়া হয়েছে। তারা এখন এর ওপর কাজ করবে।”
বিমানের এই কর্মকর্তা তথ্য দেন, থার্ড টার্মিনালে চেক-ইন কাউন্টার হবে ১৫০টি, এখানে আছে ৮৬টি। বোর্ডিং ব্রিজের সংখ্যা বাড়বে, একসঙ্গে ১১টি এয়ারক্রাফট এখানে দাঁড়াবে। সুতরাং এখানে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের কাজ আরও বেড়ে যাবে। একসঙ্গে ২০টি এয়ারক্রাফট পরিচালনা করতে ৩ হাজার ৮৭৮ জন ম্যান পাওয়ার লাগবে। তবে বর্তমান জনবল রয়েছে ২ হাজার ৪৯৪ জনের। আরও ১৩৮৪ জনকে নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন কামরুল ইসলাম উড়োজাহাজ উড্ডয়ন ও অবতরণের ক্ষেত্রে ‘কেবল পিক টাইমে কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে’ বলে দাবি করেন।
শুক্রবার বনানী থেকে বিমানবন্দরে যেতে যে তিন ঘণ্টা সময় লেগেছে, সেটা ‘আতিফ আসলামে’র কনসার্টের কারণে বলে যুক্তি দেন তিনি।
এটিজেএফবির প্রেসিডেন্ট তানজীম আনোয়ারের সভাপতিত্বে অন্যদের মধ্যে বেবিচকের সদস্য (অপারেশন্স এন্ড প্ল্যানিং) এয়ার কমোডর আবু সাঈদ মেহবুব খান, এয়ার অ্যাস্ট্রার সিইও ইমরান আসিফ, এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ উইং কমান্ডার এটিএম নজরুল ইসলাম, থাই এয়ারওয়েজের এয়ারপোর্ট সার্ভিস সুপারিন্টেন্ডেন্ট সৈয়দ ইয়াসেরুল আলম, এয়ার ইন্ডিয়ার এয়ারপোর্ট ম্যানেজার শয়নদেব ঘোষ, টার্কিশ এয়ারলাইন্সের স্টেশন ম্যানেজার সেরকান অ্যাকেন, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের জিএম কামরুল ইসলাম, কয়েকটি এয়ারলাইন্সের জিএসএ টাজ গ্রুপের এ কে এম মজিবুর রহমান, অ্যাটাব সভাপতি আবদুস সালাম আরেফ, বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট কবির আহমেদ আলোচনায় অংশ নেন।