‘ছাত্রজীবন মধুর জীবন, যদি না থাকে এক্সামিনেশন’—অনেক শিক্ষার্থীই হয়তো পরীক্ষার আগের রাতে উদাস হয়ে এ কথা ভেবেছেন কিংবা ভাবতে থাকেন। বইপুস্তকে হাবুডুবু খেয়ে ‘কে যে পরীক্ষা আবিষ্কার করেছিল, তারে যদি হাতের কাছে পাইতাম…’ এমন ভাবনাও অনেকের মাথায় এসে থাকতে পারে।
পরীক্ষা কে আবিষ্কার করেছেন, সেটা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। গুগল সার্চ করে এক মার্কিন ভদ্রলোকের নাম পাওয়া গেল বটে। হেনরি ফিশেল। তাঁকেই আধুনিক পরীক্ষাপদ্ধতির জনক মনে করা হয় (যদিও পরীক্ষাপদ্ধতির শুরু সভ্যতার গোড়ার দিকেই)। শিক্ষকতা করতেন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটিতে, ছিলেন ইমেরিটাস অধ্যাপক।
একদিন তাঁর মনে হলো, চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর আগে যেকোনো ঘটনা বা ব্যক্তিকে সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই করা দরকার। আর এই যাচাই-বাছাইয়ের জন্য দরকার একটি সুনির্দিষ্ট পরীক্ষাপদ্ধতি।
এখন নজর দেওয়া যাক বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় পরীক্ষার (মূল্যায়ন) ওপর।
দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে যুগোপযোগী ও আধুনিক করে গড়ে তুলতে সরকার ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২১: প্রাক্-প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণি’ প্রণয়ন করেছে।
২০২৩ সাল থেকে প্রাক্-প্রাথমিক ও প্রথম শ্রেণি এবং ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে পাঠ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। ২০২৪ সালে দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে শ্রেণি কার্যক্রম বাস্তবায়ন করেছে। এর ফলস্বরূপ আগামী বছর (২০২৫) নতুন শিক্ষাক্রমে এসএসসির মূল্যায়ন হতে চলেছে।
কিন্তু আমরা কি মূল্যায়নে অংশগ্রহণ করতে যাওয়া কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পরিষ্কারভাবে বলতে পেরেছি যে তাদের মূল্যায়ন কেমন করে কত নম্বরের হবে? শুধু শিক্ষার্থী নয়, অভিভাবকদের মধ্যে কি স্পষ্ট ধারণা তৈরি করতে সরকার পেরেছে? যাঁরা মূল্যায়ন করবেন (শিক্ষক), তাঁদের সেই মানের দক্ষতা আর অভিজ্ঞতা কি তৈরি হয়েছে?
নবম–দশম কিংবা কলেজে পড়ার সময় আমাদের জীববিজ্ঞান, রসায়ন কিংবা পদার্থবিজ্ঞানের যে ব্যবহারিক পরীক্ষা হতো, সেখানে সেই শিক্ষকেরা কি আমাদের স্বাধীনভাবে নম্বর দিতে পারতেন?
আমরা তো দপ্তরিকে টাকা দিতাম, স্যাররা টাকা নিতেন। সেভাবেই নম্বরটা দেওয়া হতো। বাংলাদেশের যে সামাজিক অবস্থা, এখানে যে মানের শিক্ষকেরা নিয়োগ পান, তাঁদের ওপর যে রাজনৈতিক চাপ থাকে, তাতে ক্ষমতাসীন দলের কোনো নেতার (তথাকথিত নেতা) সন্তানকে কোনো শিক্ষক কম নম্বর দিয়ে পার পেতে পারবেন? এমন প্রশ্ন অপ্রাসঙ্গিক নয় নিশ্চয়ই?
নতুন শিক্ষাক্রমের কার্যকারিতা প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন বলেন, ‘নতুন সিদ্ধান্ত অনুসারে ৩৫ শতাংশ নম্বর দেওয়া হবে ধারাবাহিক মূল্যায়নের অংশ হিসেবে। কিন্তু আমরা কি আমাদের শিক্ষকদের সেই পরিমাণ স্বাধীনতা, সেই পরিমাণ বেতন দিই? সেই মানের শিক্ষক কি আমরা নিয়োগ দিতে পেরেছি? সেই রাজনৈতিক পরিবেশ, সেই সামাজিক পরিবেশ কি তাঁদের জন্য তৈরি করতে পেরেছি? আমাদের শিক্ষকেরা কি স্বাধীনভাবে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করার মতো করে তৈরি আছেন?’ (দ্য ডেইলি স্টার বাংলা, ১৬ মে ২০২৪)
আমরা যদি ফিনল্যান্ড বা জাপানের শিক্ষাব্যবস্থার কথা বলি, তাহলে সেখানকার সমাজ ও রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে আমাদের বাস্তবতার ফারাকও দেখতে হবে। নতুন এই পদ্ধতি কোনোভাবেই আমাদের সমাজের সঙ্গে যায় না। তাই আগে সমাজ তৈরি করতে হবে। তারপর সে অনুসারে ব্যবস্থার কথা চিন্তা করতে হবে।
নতুন শিক্ষাক্রমে লিখিত অংশের ওয়েটেজ ৬৫ শতাংশ আর ৩৫ শতাংশ নম্বর দেওয়া হবে ধারাবাহিক মূল্যায়নের অংশ হিসেবে। তা–ও আবার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নয়। এনসিটিবির উচ্চ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘লিখিত অংশের ওয়েটেজ ৬৫ শতাংশ করা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়নি। আরেকটু পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হবে।’ (প্রথম আলো, ১৩ মে ২০২৪)
মূল্যায়নটি দ্রুত চূড়ান্ত করা প্রাসঙ্গিক। কারণ, বর্তমানে যারা নবম শ্রেণিতে পড়ে, তারা নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী প্রথমবারের মতো এসএসসি পরীক্ষা দেবে। নবম শ্রেণিতে তাদের অধ্যয়নকাল পাঁচ মাস পেরিয়ে ছয় মাস ছুঁই ছুঁই। কিন্তু তাদের এসএসসি পরীক্ষার মূল্যায়ন কেমন করে হবে, সেটি এখনো চূড়ান্ত হয়নি।
গত বছরগুলোয় যারা এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিল, তাদের পূর্বপ্রস্তুতির সঙ্গে দেখে আসা পূর্বঅভিজ্ঞতাও ছিল। কোন প্রশ্ন লিখলে কত নম্বর, সেই মানবণ্টনও তাদের কাছে স্পষ্ট ছিল। ফলে তারা আগে থেকেই মানসিকভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ করে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। আমরাও তা-ই করে এসেছি। কিন্তু নতুন কারিকুলামে যারা সামনে এসএসসি পরীক্ষা দেবে, তারা এখনো ধোঁয়াশার মধ্যে আছে। সামনে থেকে ধোঁয়াশা কাটবে কবে? এই পরীক্ষা-নিরীক্ষার শেষ কোথায়?
শিক্ষা হলো জ্ঞানলাভের একটি পদ্ধতিগত প্রক্রিয়া ও ব্যক্তির সম্ভাবনার পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনের অব্যাহত অনুশীলন। শিক্ষা প্রক্রিয়ায় কোনো ব্যক্তির অন্তর্নিহিত গুণাবলির পূর্ণ বিকাশের জন্য উৎসাহ দেওয়া হয় এবং তাকে সমাজের একজন উৎপাদনশীল, দায়িত্ববান সদস্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভের জন্য যেসব দক্ষতা প্রয়োজন, সেগুলো অর্জনে সহায়তা করা। তবেই শিক্ষা হবে আনন্দের, শিক্ষা হবে স্বতঃস্ফূর্ত, চিত্তাকর্ষক, শিক্ষা হবে বিশ্বমানের, শিক্ষা হবে উন্নত চিন্তার, শিক্ষা হবে একই পদ্ধতির, সেক্যুলার ও বিজ্ঞানভিত্তিক।
শিক্ষা হবে সর্বজনীন। শিক্ষা হবে সহজলভ্য ও প্রাণচাঞ্চল্য। শিক্ষা হবে মানবিক, আধুনিক ও যুক্তিনির্ভর। তবেই প্রগতি হবে মানুষের, সমাজ অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আলোর মুখ দেখবে ও কুসংস্কার থেকে হবে মুক্ত। তবেই মিলবে মানবের মুক্তি, সাধিত হবে শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য ও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবে মূল্যায়ন।