মাস দুয়েক আগেও মনে হচ্ছিল মাখনের মধ্যে ছুরি চালানোর মতো মসৃণ হবে নরেন্দ্র মোদির প্রধানমন্ত্রিত্বের হ্যাটট্রিক। অথচ কী আশ্চর্য! ভোট শুরু হওয়া মাত্র ক্ষণে ক্ষণে বদলেছে নির্বাচনী চালচিত্রের রং। আগামী শনিবার সপ্তম ও শেষ দফার ভোট। সেদিন সন্ধ্যা থেকেই গণমাধ্যম দেখাবে বুথফেরত সমীক্ষার ফল। তাতে জেতা-হারার একটা আন্দাজ পাওয়া যাবে। যদিও চক্ষুকর্ণের বিবাদ ভঞ্জন ৪ জুন।
এত দ্রুত ধারণা বদলের প্রধান কারণ হাওয়াহীনতা। প্রথম দফার ভোট দেখেই বোঝা যায়, কোথাও সেভাবে ভোটের হাওয়া নেই। আগের মতো মোদির নামে আসমুদ্রহিমাচলে পাগলামো যেমন নেই, তেমনি তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলেও গভীর আক্রোশের বহিঃপ্রকাশ নেই। বিশেষ কোনো বিষয়ও ভোটের সর্বজনীন ইস্যু হচ্ছে না। জনমতের চরিত্র পুরোপুরি স্থানীয়।
অতিদ্রুত আরও উপলব্ধি হয়, ‘ইন্ডিয়া’ জোটের শরিকেরা সবাই এক সুরে প্রচার চালাচ্ছে। প্রত্যেকের কণ্ঠে শুধুই সরকারের ১০ বছরের ‘ব্যর্থতার’ খতিয়ান। তীব্র বেকারত্ব, গগনচুম্বী মূল্যবৃদ্ধি, ধনী-দরিদ্রের চরম অর্থনৈতিক বৈষম্য, প্রধানমন্ত্রীর শিল্পপ্রীতি, আদানি-আম্বানি, প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিহিংসা এবং গণতন্ত্র ও সংবিধান রক্ষার প্রয়োজনীয়তা ছাড়া বিরোধীরা অন্য বিষয়ে আগ্রহী নয়। বিরোধী প্রচারের এই একমুখী চরিত্রের মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী তুলে ধরলেন ‘মুসলমান জুজু’। উদ্দেশ্য, উগ্র হিন্দুত্ববাদের চেনা ও পরিচিত আঙিনায় বিরোধীদের টেনে নামানো। কিন্তু সেখানেও তাঁদের আশাহত হতে হলো। কারণ, শাসকের সেই ফাঁদে বিরোধীরা পা দিল না।
অন্য একটি বিষয়ও এই প্রথম মাথাচাড়া দিয়েছে। সামাজিক মাধ্যম। দেশের গণমাধ্যমগুলো শাসক দলের আজ্ঞাবহ। ‘গোদি মিডিয়া’ নামে তারা পরিচিত। বড় খবরের কাগজ ও টেলিভিশন চ্যানেলের সহায়তা না পাওয়ায় বিরোধী রাজনীতি আবর্তিত হতে থাকে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে। সরকারের যে সমালোচনা ‘গোদি মিডিয়া’ করে না, যে সত্য সেখানে উদ্ঘাটিত হয় না, তা আশ্রয় পেতে থাকে বিকল্প সামাজিক মাধ্যমে। তারা জানাতে থাকে বিজেপির চেনা ন্যারেটিভ কতটা অসাড়, প্রকৃত সত্যই বা কী। আগের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি ও তার আইটি সেলকে এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হয়নি।
ভোট শুরু হতেই ধরা পড়তে থাকে বিজেপির শক্তি ও দুর্বলতাগুলো। এ কথা অনস্বীকার্য, ১০ বছর ধরে মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি নিজস্ব কিছু ঘাঁটি তৈরি করেছে। হিন্দুত্ববাদী চেতনার বিকাশের পাশাপাশি বিভিন্ন সরকারি জনমুখী প্রকল্প রাজ্যে রাজ্যে গড়ে তুলেছে এক বিপুল সুবিধাভোগী জনতা। ক্রমেই এই জনতার একাংশ অন্ধ অনুগামীতে পরিণত।
পাশাপাশি সরকারের নিরন্তর প্রচারে ভারতের ‘বিশ্বগুরু’ হয়ে ওঠা, গোটা দুনিয়ার সম্ভ্রম আদায় করা, পৃথিবীর জনপ্রিয়তম নেতা হিসেবে মোদির উঠে আসা, তাঁর কঠোর ও কঠিন নেতৃত্বদানের ক্ষমতা আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে তাঁদের কাছে, যাঁরা মনে করেন শক্তিশালী ভারতের জন্য শক্তপোক্ত কেন্দ্রীয় সরকার জরুরি। যুক্তরাষ্ট্রের পিউ রিসার্চও দেখাচ্ছে, এই মহল মনে করে অতি গণতান্ত্রিকতা সরকারের গতি মন্থর করে, ভারতের মতো দেশের অর্থনীতির জন্য যা মঙ্গলকর নয়। ওই ধারণা ক্রমেই মোদিকে ‘নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্রী’ করে তুলেছে। ভোটের বাজারে এই মোদিই বিজেপির ‘ইউএসপি’।
কিন্তু ভোট শুরু হতেই বোঝা গেল, তীব্র কৃষক অসন্তোষ, চাকরিহীন অর্থনৈতিক প্রগতি, অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির সুরাহা ১০ বছরে না হওয়ায় মোদি-মাহাত্ম্য ফিকে হয়েছে। নতুন স্বপ্ন ফেরি করতেও এবার তিনি ব্যর্থ।
স্বপ্ন যে একেবারেই দেখাননি তা কিন্তু নয়। কিন্তু ‘বিকশিত ভারতের’ স্বপ্ন মানুষকে আচ্ছন্ন করতে পারেনি ১০ বছর আগে শোনানো ‘আচ্ছে দিন’ না আসায়। ফলে নির্বাচনটা হয়ে ওঠে বিজেপির অর্থ বল, প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি ও সাংগঠনিক দক্ষতার সঙ্গে বিরোধীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার। কোথাও তা বিজেপির দিকে গেছে একতরফা, কোথাও বিরোধীদের পক্ষে, কোথাও বা মিশ্র। অধিকাংশ ভোট বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকদের ধারণা, এবারের নির্বাচন একেবারেই একপেশে নয়। যদিও মোদির বিপরীতে কোনো মুখ না থাকায় পাল্লা শাসকের দিকে কিছুটা ঝুঁকে। তবে চ্যালেঞ্জও প্রচুর।
ফলাফলের বিতর্কে না ঢুকে বলা যায়, এবারের ভোট চরিত্র চিত্তাকর্ষক ও সাসপেন্সে মোড়া। যেহেতু হাওয়াহীন, রাজ্যে রাজ্যে ইস্যুও পৃথক, সেহেতু স্পষ্ট মতিগতি বোঝা ভার। চারটি বিষয় নির্ণায়ক ভূমিকা নিতে পারে।
প্রথমটি দলিত সমাজ। কংগ্রেস যত দুর্বল হয়েছে, দলিত সমাজ তত বিচ্ছিন্ন হয়েছে। ব্রাহ্মণ্যবাদী বিজেপির সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং সেই দলিত সমাজের একাংশকে কাছে টেনেছে। বাকিরা খুঁজে নিয়েছে অন্য আশ্রয়। যেমন উত্তর প্রদেশে বহুজন সমাজ পার্টি। সেই দলিত সমাজের সামনে কংগ্রেস এবার তুলে ধরেছে আম্বেদকরের অসম্মানের প্রশ্ন। আঘাত হেনেছে দলিত গরিমায়। তারা অবিরাম প্রচার করছে, মোদি তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হলে আম্বেদকরের সংবিধান ও গণতন্ত্র উচ্ছন্নে যাবে। ছত্রখান করে দেবে দলিত, অনগ্রসর, তফসিলভুক্তদের সংরক্ষণব্যবস্থা। সংবিধান ও গণতন্ত্র রক্ষার মতো বিমূর্ত বিষয় এভাবে ভোটে আলোড়ন ফেলবে কেউ ভাবেনি। অথচ সেটাই বাস্তব। এর সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে বিজেপি। এবারের ভোটে আপাত নির্জীব ও উদাসীন মায়াবতীকে ছেড়ে দলিত ভোটের একাংশ ‘ইন্ডিয়া’য় আশ্রয় নিলে উত্তর প্রদেশে বিজেপির কপাল পুড়তে পারে। দিল্লির দরবার দখলের রাস্তা কিন্তু চিরকাল উত্তর প্রদেশ হয়েই আসে।
দ্বিতীয়টি ‘অগ্নিবীর’ প্রকল্প। সেনাবাহিনীতে স্বল্পমেয়াদি এই ‘চুক্তির চাকরি’ বাতিলের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ‘ইন্ডিয়া’। শহিদ হওয়া জওয়ানদের শ্রেণিবিভাজন তুলে দিয়ে পুরোনো প্রথায় স্থায়ী চাকরির আশ্বাস উত্তর ভারতের বেকারদের নতুন আশার আলো দেখিয়েছে। বিজেপি শঙ্কিত। প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংকে বলতে হচ্ছে, জিতলে তাঁরা ওই প্রকল্প পর্যালোচনা করবেন।
তৃতীয়ত, কোটি কোটি লাখোপতি তৈরি ও শিক্ষিত বেকারদের বছরে এক লাখ টাকার শিক্ষানবিশ অনুদানের কংগ্রেসি প্রতিশ্রুতি। নিয়ম করে রাহুল গান্ধী বলে চলেছেন, প্রতি মাসে ব্যাংক হিসাবে সাড়ে আট হাজার টাকা পড়বে খটাখট খটাখট। এই ‘খটাখট খটাখট’ অন্য এক ধরনের সাড়া ফেলেছে।
চতুর্থত, রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের (আরএসএস) নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়া। বিজেপি সভাপতি জেপি নাড্ডা নিজেদের ‘সক্ষম’ হয়ে ওঠার কথা বলে আরএসএসের সাহচর্য অপ্রয়োজনীয় জানিয়ে দিয়েছেন। ‘স্বেচ্ছাচারী’ মোদি দলকে কুক্ষিগত করে সংঘের কর্তৃত্ব অপ্রাসঙ্গিক করে তুলেছেন। গড়ে তুলেছেন নিজস্ব ‘পারসোনালিটি কাল্ট’। জানিয়েছেন, তিনি ঈশ্বরপ্রেরিত। পরমাত্মার অংশ। অবিনশ্বর। উপেক্ষিত সংঘ সেভাবে সক্রিয় নয়। তা সত্ত্বেও মোদির বিজেপি বৈতরণি পেরোলে তা হবে একান্তই তাঁর কৃতিত্ব।
বাড়তি আরও একটা বিষয়ও বহু চর্চিত। যোগী-ভাগ্য। অরবিন্দ কেজরিওয়াল একই দিনে দুটো বোমা ফাটিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ৭৫ পূর্তির পর মোদি অবসর নিলে অমিত শাহ হবেন তাঁর উত্তরসূরি। আর বলেছিলেন, মোদি হ্যাটট্রিক করলে দুই মাসের মধ্যে তিনি উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথকে সরিয়ে দেবেন। বিজেপি প্রথমটির বিরোধিতা করেছে তীব্রভাবে। কিন্তু যোগী প্রশ্নে সবাই নির্বাক। যোগী ও তাঁর ‘ক্ষত্রিয়’ সমাজ মুখ ঘোরালে মোদি কি তরাবেন? রাজস্থান, গুজরাট ও পশ্চিম উত্তর প্রদেশের রাজপুতরাও যখন ক্ষুব্ধ? এই প্রশ্নও প্রভূত আলোচিত।
বিজেপির পক্ষে বাড়তি আসন পাওয়ার জায়গা ওড়িশা, তেলেঙ্গানা ও অন্ধ্রপ্রদেশ। সাকল্যে ১৫টি। রামকৃষ্ণে শরণাগত পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি বিজেপির রামকে আঁকড়ে ধরলে বাড়তি হয়তো আরও পাঁচ। উত্তর ও পশ্চিম ভারতের বিপুল লোকসান কি তা পুষিয়ে দেবে?
৪ জুন চক্ষুকর্ণের বিবাদ ভঞ্জনের দিন। সেদিন নজরে স্রেফ ইভিএম, যা নিয়ে বিরোধীরা সন্দেহ ও সংশয়মুক্ত নয়। নির্বাচন কমিশনের প্রতি বিরোধীদের আস্থার অভাব ১০ বছর ধরে ধীরে ধীরে বেড়েই চলেছে।