গৌতম বুদ্ধ এমনই এক মহামানব, যিনি আড়াই হাজার বছর আগে জন্মেও আজকের দিনে মানবসভ্যতার কাছে সমান আবেদন নিয়ে উপস্থিত। যিশুখ্রিষ্ট এবং হজরত মুহাম্মদ (স.)-এর বাণী, যা বাইবেল ও কুরআনে বিধৃত বা বেদ-রামায়ণ-মহাভারতের অবিনাশী শিক্ষা; তেমনি বুদ্ধবাণী। পৃথিবীর মঙ্গল বিধানে বুদ্ধের জীবন ও উপদেশ চিরস্থায়ী ভূমিকা রাখবে।
কপিলাবস্তুর রাজপুত্র হয়ে জন্ম তার। শুদ্ধোদন ও মহামায়ার পুত্র হয়ে। কোনো এক বৈশাখী পূর্ণিমায়। শুক্রবার। জন্মের সাত দিনের মাথায় মাতৃবিয়োগ। পালিত হন মাসি গোতমীর হাতে। পঞ্চম দিনে নামকরণ। জ্যোতিষীরা ভাগ্য গণনা করে যেহেতু তিনি সন্ন্যাসী হবেন জানান; পিতা অতিরিক্ত বিলাসব্যসনে তাকে মানুষ করতে থাকেন। তার জন্য নির্মিত হয় তিন তিনটি ভোগসুখের প্রাসাদ, যেখানে তিনি গ্রীষ্ম, বর্ষা ও হেমন্ত অতিবাহন করবেন। কিন্তু নিয়তি যে তাকে অন্য উদ্দেশ্যে নিয়োজিত করবেন! তাই উনিশ বছরে যশোধরার সঙ্গে বিবাহিত ও আষাঢ়ী পূর্ণিমায় জাত রাহুলের জনক তিনি সারথি ছন্দককে নিয়ে নগর পরিভ্রমণে গিয়ে পথে জরা-ব্যাধি-মৃত্যু দেখলেন। দেখলেন সন্ন্যাসীও। উপলব্ধি করলেন জীবনের অসাড়তা। ২৯ বছর বয়সে মানবমুক্তির লক্ষ্যে ঘর ছাড়লেন। মহাভিনিষ্ক্রমণ ঘটল তার।
সেই যে ছন্দককে সারথি করে রাজ্যসীমা পেরিয়ে রথ থেকে নেমে পরিধেয় সমর্পণ করলেন তাকে; এবং তরবারি দিয়ে নিজ কেশ কর্তন করে তা ছড়িয়ে দিলেন মহাকাশে (কথিত আছে, সেই কেশগুচ্ছ অন্তরীক্ষেই রয়ে গিয়েছিল। মাটিতে পড়েনি); দীর্ঘ ছয় বছর তার কেটেছে কঠিন তপশ্চর্যায়। স্থানে স্থানান্তরে। উপলব্ধি করলেন যে মধ্যপন্থাই অবলম্বনীয়। সুজাতার স্বর্ণপাত্রে আনীত পায়সান্ন খেয়ে পাত্রটি নদীতে ভাসালে স্রোতের বিপরীতে চলতে লাগল সেটি!
‘ইহাসনে শুষ্যতু মে শরীরম’! বজ্রাসনে বসে এবার চূড়ান্ত তপ ও তাতেই সিদ্ধি! বোধিবৃক্ষতলে বোধিলাভ! ৩৫ বছর বয়সে। সেই বৈশাখী পূর্ণিমায়। বুধবার। শতবিঘ্নকারী মার এসেও ব্যাঘাত ঘটাতে ব্যর্থ হলো। চতুরার্যসত্যও অষ্টাঙ্গিক মার্গ এবং প্রতীত্যসমুত্পাত প্রচার করলেন। সারনাথের ঋষিপত্তনে প্রথম দীক্ষা দিলেন পাঁচ জনকে, বৌদ্ধদের কাছে যা ‘ধর্মচক্রপ্রবর্তন’ নামে খ্যাত। দিনটি ছিল আষাঢ়ী পূর্ণিমা। এরপর সুদীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে ভারতের নানা স্থানে গিয়ে ধর্ম প্রচার। আমরা মোটামুটি তা জানি। ৮০ বছর বয়সে কুশিনগরে তার মহাপরিনির্বাণ! সেই বৈশাখী পূর্ণিমায়। আজ বুদ্ধের সময়কাল থেকে আড়াই হাজার বছরেরও অধিক দিন অতিবাহিত। বাঙালি এবং এই উপমহাদেশ বা সমগ্র পৃথিবীতে আজ গৌতম বুদ্ধের ভূমিকা ও প্রাসঙ্গিকতা কতখানি? এবার তা দেখব আমরা।
পৃথিবীতে এখন তুলনামূলক ধর্মচর্চা ধ্রুপদি রূপ লাভ করেছে। তাতে এক ধর্মের সঙ্গে অন্য ধর্ম এবং ধর্মের সার্বজনীনতার অনুসন্ধান চলছে। তাই দেখি যে চীনের প্রাচীন তাওবাদ তাদের গুরু লাওতেস-কে Reincarnation of Buddha বলছে। সনাতন হিন্দু ধর্মের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন যে বুদ্ধ; কবি জয়দেবের ভাষায় যিনি ‘নিন্দতি যজ্ণ; তাকেই সেই ধর্মের অন্যতম অবতার বানানো হয়েছে। আহমদিয়া সম্প্রদায়ের চতুর্থ খলিফা মির্জা তাহির আহমেদ ‘Revealation Nationality Knowledge and Truth’ গ্রন্থে বুদ্ধকে ‘Prophet’ বলেছেন। সাঁচীর অশোকস্তূপে Isana আছে। তার অর্থ ঈশ্বর। মির্জা আরো বলেন, পবিত্র কোরআনে ‘Dhul Kifl’ কপিলাবস্তুর নামান্তর। শিখদের দশম তথা শেষ গুরু গোবিন্দসিং বুদ্ধকে অবতার মানতেন। পবিত্র ‘গ্রন্থসাহেব’-এ বুদ্ধবাণীও সংকলিত। আবার খ্রিষ্টধর্মেও নানাভাবে তিনি অনুসৃত। খ্রিষ্টধর্মের অন্যতর পাঠে দেখা যায়, যিশু ভারতে এসেছেন। জার্মান পণ্ডিত হোলগর কলস্টনের ‘Jesus Lived in India’তে বলেন; কনিষ্ক আয়োজিত চতুর্থ বৌদ্ধ সগীতিতে যোগ দিতে যিশু কাশ্মীরে উপস্থিত ছিলেন। শিহরিত হওয়ার মতো ঘটনা। তবে এর নিশ্ছিদ্র প্রমাণ নেই। বুদ্ধের বাণীর দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন তিনি। বাস্তবে বুদ্ধের একটি সদুক্তি ‘যো ধম্মং পস্সতি সো মাং পস্সতি’ (যে আমাকে দেখে সে ধর্মকে দেখে) আর যিশুর বাণী ‘He that sight me him that sont me (যে আমাকে দেখে সে তাঁকে দেখে) বাক্য দুটিতে মিল অসম্ভব। যে মিল বুদ্ধের ‘আত্মানং বিদ্ধি’র সঙ্গে সক্রেটিসের ‘Know thyself’-এর! অন্যদিকে New Testament আর সংস্কৃতে লেখা বুদ্ধজীবনী ‘ললিতবিস্তর’-এর কোনো কোনো স্থলে আশ্চর্য মিল দেখা যায়।
ভারতবর্ষ ছিল একদা বৌদ্ধদের সংস্কৃতি ও গরিমার পীঠস্থান। সুবিশাল ত্রিপিটক রচিত হয়েছে যেমন, তেমনি পালি ও সংস্কৃত ভাষার উন্নতি ঘটেছে বহু বৌদ্ধ পণ্ডিতের অবদানস্বরূপ। স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের দিক দিয়েও কম ভূমিকা নেই। সাঁচি সারনাথ ভারহুত। অজন্তা ও গান্ধারশিল্প বিশ্বখ্যাত। দিকে দিকে বিশ্ববিদ্যালয়-তক্ষশিলা নালন্দা কর্ণসুবর্ণ বিক্রমশীলা ওদন্তপুরী সোমপুর। আরো। থেরগাথা থেরীগাথা। বুদ্ধচরিত। মিলিন্দ পনহো। চর্যাপদ। পালযুগ ছিল বাংলা তথা ভারতের এক বিরাট অঞ্চলের বৌদ্ধ সভ্যতা-সংস্কৃতি বিকাশের যুগ। মহামতি অশোক বৌদ্ধধর্মকে ছড়িয়ে দেন বৃহত্তর পৃথিবীতে। চীন, জাপান, মিয়ানমার, তিব্বত, আফগানিস্তান থেকে শুরু করে ইউরোপের নানা দেশে এই ধর্মের বিস্তার ঘটেছে। তাকে নিয়ে বই লিখেছেন য়ু থান্ট, যিনি রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাবেক প্রধান। লিখেছেন হারমান হেজ। গবেষণা করেছেন রিজ ডেভিডসহ অনেকেই।
বাঙালির কাছে বুদ্ধ অতি শ্রদ্ধেয় এক নাম। ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথ আর সনাতনপন্থি বিবেকানন্দ দুজনেই তার পদপ্রান্তে অবনত! সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাকে নিয়ে বই লেখেন। ‘অমিতাভ’ কাব্য রচনা করেন কবি নবীনচন্দ্র সেন। রবীন্দ্রনাথের আদেশে রথীন্দ্রনাথ অনুবাদ করেন অশ্বঘোষের ‘বুদ্ধচরিত’। ঈশানচন্দ্র ঘোষের অনুবাদে পাই ছখণ্ডে ‘জাতক’। রবীন্দ্রনাথের অজস্র লেখায় বুদ্ধ মূর্ত। বিভূতিভূষণ ও শরদিন্দু তাকে নিয়ে অসাধারণ গল্প লেখেন। ‘অপরাজিত’ উপন্যাসে অপুর ছেলে কাজলের প্রকৃত নামই তো অমিতাভ! সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসু লিখেছেন; তার জন্মের ছয় দিনের মাথায় মায়ের মৃত্যুই তার নামকরণের কারণ। বাঙালির ছেলে অমিতাভ বুদ্ধ গৌতম মারজিত সিদ্ধার্থ অহরহ পাই। পশ্চিমবঙ্গের দুই সাবেক মুখ্যমন্ত্রীর একজন ছিলেন সিদ্ধার্থ, অন্যজন বুদ্ধদেব! বহু বৌদ্ধশাস্ত্রবিদ আছেন বাঙালি তথা ভারতীয়দের মধ্যে। বেণীমাধব বড়ুয়া থেকে রাহুল সাংকৃত্যায়ন। আম্বেদকর। দামোদর ধর্মানন্দ কৌশাম্বী ভারত তথা বিশ্বখ্যাত বৌদ্ধ পণ্ডিত।