1. [email protected] : admin :
  2. [email protected] : Shahriar Rahman : Shahriar Rahman
  3. [email protected] : Jannatul Naima : Jannatul Naima
শিরোনাম :
সিরিয়ায় ‘চোরাগোপ্তা’ হামলায় ১৪ পুলিশ নিহত ৪২ ঘণ্টা পর রাঙামাটির নদীতে মিলল নিখোঁজ ২ পর্যটকের লাশ নাশকতা কি না, তদন্তের পর বলা যাবে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা পাহাড়ে ত্রিপুরা পাড়ায় পুড়েছে ১৭ ঘর, বাসিন্দারা ছিলেন বড়দিনের উৎসবে গণপিটুনি দিয়ে চুন-বালু মেশানো এসিড পানি খাওয়ানো হয় যুবককে, পরে মৃত্যু ছাত্রদল নেতাকে পিটিয়ে হত্যা, অভিযোগ বিএনপি নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে আল্লাহর ওয়াস্তে দুর্নীতি-চাঁদাবাজি থেকে সরে আসুন: আসিফ মাহমুদ যাদুকাটায় পাথর-বালু উত্তোলন, ১৭ শেইভ মেশিন জব্দ জাহাজে ৭ খুন: একমাত্র উপার্জনক্ষমকে হারিয়ে দিশেহারা সালাউদ্দিন-আমিনুলের পরিবার বিশ্বশান্তি কামনা বড়দিনের প্রার্থনায়

টাঙ্গাইলে কাঁসা-পিতল শিল্পে হাহাকার

  • আপডেট : শনিবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০২৪
“এগুলো বানানো খুবই কষ্টকর এবং সময়সাপেক্ষ। আমি এই কাজ করে বহু টাকার ঋণে পড়ে ছাড়ান দিছি।”
“এগুলো বানানো খুবই কষ্টকর এবং সময়সাপেক্ষ। আমি এই কাজ করে বহু টাকার ঋণে পড়ে ছাড়ান দিছি।”

“এগুলো বানানো খুবই কষ্টকর এবং সময়সাপেক্ষ। আমি এই কাজ করে বহু টাকার ঋণে পড়ে ছাড়ান দিছি।”

“আগে বিভিন্ন জায়গা থেকে পিতলের কারিগর বা পাইকাররা তৈজসপত্র নিয়ে আসতেন। লোক আসত ভারত থেকেও। এখন সেই কারিগরও নাই, তাই এই শিল্প কালের বির্বতনে হারিয়ে যাচ্ছে। সেই জৌলুসও নেই।”

“মানুষ এখন কাঁসা-পিতলের বিকল্প জিনিস হাতে নাগালে পেয়ে এইগুলো ব্যবহার করা বাদ দিয়ে দিছে।”

এমনটাই বলছিলেন, টাঙ্গাইল সদর উপজেলার মগড়া এলাকার কাঁসা-পিতলের ব্যবসায়ী প্রবীর কর্মকার।

টাঙ্গাইলের কাঁসা-পিতলের শিল্পের তৈজসপত্রের এক সময় বেশ নাম-ডাক থাকলেও এখন তা প্রায় বিলুপ্তির পথে। প্রয়োজনীয় কাঁচামাল, বাজার ব্যবস্থাপনা, কারিগরের অভাব, প্লাস্টিক, মেলামাইন, চিনামাটি, কাঁচের তৈজসপত্রের ভিড়ে মুখ থুবড়ে পড়েছে এ শিল্প। পাশাপাশি অধিক পরিশ্রম, কম মজুরি, বিক্রি ও লাভ না হওয়ায় অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন এই শিল্পের কারিগররা।

ব্যাপক প্রসিদ্ধ ও চাহিদার ভিত্তিতে টাঙ্গাইলের বিভিন্ন স্থানে কাঁসা ও পিতলের শিল্প গড়ে উঠলেও সদর উপজেলার কাগমারী ও সাকরাইল গ্রাম এবং সদর উপজেলার মগড়া গ্রাম বেশি প্রসিদ্ধ ছিল। মগড়া ও কাগমারী দুটি গ্রামে বাস করে ৫০টি বেশি পরিবার। তাদের অনেকেই বেছে নিয়েছে অন্য পেশা। ফলে কমে যাচ্ছে কাঁসা ও পিতল শিল্পীর সংখ্যা।

কদর কমলেও এসব এলাকার কাঁসা ও পিতলের কারিগররা এখনও অত্যন্ত নিপুণ হাতে নিরলস শ্রম দিয়ে তামা, কাঁসা ও পিতলের থালা, বাটি, কলস, গ্লাস, জগ, ঘটি, লোটা, পঞ্চপ্রদীপ, চামচ, কাজলদানি, ডেকচি, বোল, খুন্তি, বাটি, পুতুল, ঝুনঝুনি, করতাল ও মেডেলসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র তৈরি করছেন।

এ শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা বলছেন, টাঙ্গাইলের কাঁসা ও পিতলের তৈরি তৈজসপত্রের ব্যাপক চাহিদা ছিল সারাদেশে। এর সুনাম ছিল বাংলাদেশ ছাড়িয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও। দেশের চাহিদা মিটিয়েও কাঁসা ও পিতলের সামগ্রী রপ্তানি হত বিদেশেও।

টাঙ্গাইল জেলা সদরে ঘুরে কাঁসা-পিতল নিয়ে পুরানো দিনের এসব প্রচলিত গল্পের সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিলই পাওয়া গেল না। সদরের ‘মদের ঘর দোকান’ এলাকায় কাঁসা-পিতলের চার থেকে পাঁচটি দোকান দেখা গেলেও বেচাকিনি নেই বললেই চলে। আগে সেখানে ২০ থেকে ৩০টি দোকান ছিল বলে স্থানীয়রা জানান।সেখানেই কথা হয় মগড়ার প্রবীর কর্মকারের সঙ্গে। আক্ষেপ করে তিনি বলছিলেন, “আগে পুরো টাঙ্গাইল জেলায় ১ হাজার থেকে ১২০০ পরিবার এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত ছিল। এখন কেবল ৪০ থেকে ৫০টি পরিবার এ কাজ করছেন। আগে মানুষের কাছে কাঁসা-পিতলের চাহিদা ছিল সোনার মতো। অনেকে তো সোনার বদলে বিয়ে, মুসলমানিসহ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে উপহার হিসেবে কাঁসার সামগ্রী দিত। এখন সেটাও হারিয়ে গেছে। বেড়ে গেছে কাঁসার দামও।

“পাশাপাশি নিত্য ব্যবহারের জন্য বিকল্প প্লাস্টিকের সামগ্রীর কারণে এসব জিনিস হারিয়েও যাচ্ছে। মানুষ এখন শখে কাঁসা-পিতলের তৈজসপত্র কেনে। হাতেগোনা কিছু বিয়ের অনুষ্ঠানে ব্যবহার হয়।”

তিনি বলেন, “ব্যাপক প্রসিদ্ধ ও চাহিদার ভিত্তিতে টাঙ্গাইলের বিভিন্ন স্থানে কাঁসা ও পিতলের শিল্প গড়ে উঠলেও সদর উপজেলার কাগমারী ও সাকরাইল এবং সদর উপজেলার মগড়া গ্রাম ছিল বেশি প্রসিদ্ধ। এক সময় এসব গ্রামে শত শত পরিবারে কাঁসা ও পিতলের শিল্পী ছিল। দিন-রাত তাদের কাঁসা পেটানোর শব্দে গ্রামগুলো মুখর থাকত। হিন্দুদের মধ্যে কর্মকার সম্প্রদায়ের লোকজনই এ শিল্পের সঙ্গে বংশানুক্রমে জড়িত।”

উপযুক্ত সহায়তা ও সমাদরের অভাবে এই শিল্প অন্ধকারে ধুঁকছে দাবি করে প্রবীর বলেন, “এখন কেউ পিতলের কলসি, কাঁসার জগ, গ্লাস-চামচও উপহার দেয় না। আধুনিক প্লাস্টিক, মেলামাইনের তৈজসপত্রের আমদানিতে টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী কাঁসা ও পিতল শিল্প হারাতে বসেছে। তাছাড়া বাজারের চাহিদা অনুযায়ী আধুনিক ও রুচিসম্মত জিনিস তৈরির ব্যবস্থা না থাকার কারণে এ শিল্পের চরম সংকট দেখা দিয়েছে।”

মগড়া গ্রামের কাঁসা কর্মকার ফনি চন্দ্র বাবু পেশায় স্কুল শিক্ষক হলেও ছোটবেলায় শেখা এ কাজ এখনও করে যাচ্ছেন। ছোটবেলায় পড়াশোনার পাশাপাশি বাবার কাছ থেকে কাঁসা-পিতলের জিনিসপত্র তৈরির কাজটা আয়ত্তে এনেছেন।

ফনি বলছিলেন, “এক সময় এই এলাকায় হাতুড়ির শব্দে কান পাততে পারতাম না। কিন্তু আমাদের সমস্যা হত না, তবে মানুষ আসলে শব্দ সহ্য করতে পারত না। এই গ্রামে আগে তিন শতাধিক পরিবার কাসা-তামা শিল্পের সঙ্গে জড়িত ছিল। এখন আছে ১৪-১৫টি পরিবার। এখন ছয়-সাতটা দোকান চলে। কাঁসা-পিতলের জিনিস তৈরি করতে পাট কয়লা, দস্তা, কাঠ কয়লা ও পিতল লাগে। এগুলোর দাম বেড়ে গেছে। যে কারণে কাঁসার জিনিস তৈরি করাও ব্যয়বহুল।”

তিনি বলেন, “আধুনিক প্রযুক্তির দাপটে প্রাচীন লোকশিল্পটি ক্রমশই বিলুপ্ত হতে চলেছে। এ ছাড়া দেশের স্বাধীনতার পর চোরাই পথে ব্যাপকভাবে এখানকার কাঁসা ও পিতলের জিনিসপত্র ভারতে পাচার এবং অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এই শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেক দক্ষ কারিগর দেশত্যাগ করায় বিপর্যয় নেমে আসে। এখন এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত কর্মকার সম্প্রদায়ের শত শত পরিবার মানবেতর জীবনযাপন করছেন।”

“এ ধারা অব্যাহত থাকলে এবং সরকারিভাবে উদ্যোগ না নিলে টাঙ্গাইলের প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী এ শিল্পটি কালের করাল গ্রাসে হারিয়ে যাবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।”

৬৫ বছর ধরে এ পেশায় জড়িত মগড়া এলাকার কারিগর ৭৭ বছর বয়সী অখিল কর্মকার জানালেন কীভাবে তৈরি হয় পিতলের তৈজসপত্র।

তিনি বলেন, “প্রথমে ভাঙারি পিতল আগুনে পুইড়া জুড়া করি। তারপর মইষের মধ্যে দেই। তারপর আগুনে গালাই সাড়ে ৩ ঘণ্টা। তারপর খুঁটির মধ্যে ঢালি। তারপর এগুলো ঠান্ডা হলে আবার আগুনে পোড়াই। একজনে ধরি এবং দুইজনে বাড়ি দেই। এরকম করতে ২ ঘণ্টা থেকে সোয়া ২ ঘণ্টা সময় লাগে। তারপর পিটাইয়া তৈরি করি গামলা।”

“এগুলো বানানো খুবই কষ্টকর এবং সময়সাপেক্ষ। আমি এই কাজ করে বহু টাকার ঋণে পড়ে ছেড়ে দিছি।”

৫০ বছর এ পেশায় জড়িত মগড়ার অমূল কর্মকার বলেন, ঠাকুরদা, বাবার পর তিনি এ কাজের হাল ধরেছিলেন। এখন কাজ জুটলে পেটে ভাত হয়, অনেক সময় কাজ থাকে না।

এ কাজে কোনো ভবিষ্যৎ না দেখে রাণী কর্মকারের ছেলেরা পড়াশোনা করছে। একজন বিদেশ গেছে। একজন মাস্টার্স পাস করছে।

রাণী বলেন, “ওরা চাকরি করবে, বাড়িঘর করবে এই কাজে যুক্ত হবে না। এ কাজে ভবিষ্যৎ নাই
কারিগর পণ্ডিত কর্মকার বলেন, “কাজ করি ৩৫ বছর, এ কাজে লাভ নাই। কাজ করে কিছু থাকে না। কয়লার দাম বেশি। ১ বস্তা কয়লা ১০০০ টাকা, ১ মণ পাথর কয়লা ১ হাজার ৬০০ টাকা। আমরা বেকার দেখে আর কিছু করতে পারি না। তবে ছেলেরা সোনার কাজ করে। বাপদাদার পেশার কাজই করে কোনোমতে চলি।”

মগড়ার ৭২ বছর বয়সী সুমন কর্মকার বলেন, “এখন ৮ থেকে ১০টা ঘরে কাজ হয়। আগে প্রায় ১৫০ ঘর ছিল। বিভিন্ন ধরনের জিনিস তৈরি হত, জগ, কলসি, হাতি। ঢাকা, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রংপুর, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া জেলায় যেত। তখন কাঁসা-পিতলের বিকল্প সামগ্রী ছিল না। তখন বাধ্য হয়ে কাঁসা-পিতল ব্যবহার করত। প্রচুর চাহিদা ছিল।

“যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে এগুলো পরিবর্তন হইয়া গ্যাছে। এগুলো ভারি জিনিস, ব্যবহার করতে কষ্ট হয়। কিন্তু প্লাস্টিকের তৈজসপত্র হালকা, ব্যবহার করা সহজ। কাঁসা, পিতল, চিনামাটির তৈজসপত্র তুলনামূলক কম দাম। এখনে কিচ্ছু করার নাই।”

একই কথা বলছেন টাঙ্গাইল টেকনিক্যাল অ্যান্ড বি এম কলেজের শিক্ষক মোজাম্মেল হক। তিনি বলেন, “বর্তমান যুগে প্লাস্টিকের তৈজসপত্র চাহিদা অনেক বেশি। দামে কম, ওজনে হালকা ব্যবহার করা সহজ। তাই আমি কাঁসার বিকল্প হিসেবে প্লাস্টিকের পণ্য ব্যবহার করি।”

বিসিক শিল্পী নগরীর সহকারী মহাব্যবস্থাপক শাহনাজ বেগম বলেন, “তামা, কাঁসা-পিতল আমাদের ছোটবেলা থেকেই দেখছি। কালক্রমে এটা বিলুপ্তির পথে। আমরা এখন যদি এটাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারি, তাহলে অনেক লোকের কর্মসংস্থান হবে এবং শিল্পটাকেও সমৃদ্ধ করতে পারব।”

“তামা কাঁসা পিতলের জিনিস তৈরির ওপর কোনো ট্রেনিং দেওয়া হয় না। তারা যদি আমাদের কাছে আসে, তাহলে তাদের সহযোগিতা করে শিল্পটাকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করব।”

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

এই ক্যাটেগরীর আরো খবর
© 2024  All rights reserved by Desheralo.com
Customized BY NewsTheme