চিকিৎসাশিক্ষার মৌলিক আটটি বিষয়ের শিক্ষকদের শতভাগ প্রণোদনা ভাতা দেওয়া চূড়ান্ত করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। বিষয়টি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অনুমোদন দিয়েছেন। মৌলিক বিষয়ে শিক্ষকের স্বল্পতা কমানোর উদ্দেশ্যে সরকার এমন প্রণোদনার ব্যবস্থা করেছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের শিক্ষা বিভাগের সংশ্লিষ্ট দপ্তর প্রথম আলোকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
দেশে বর্তমানে সরকারি মেডিকেল কলেজ ৩৭টি। এসব কলেজে মৌলিক ৮টি বিষয়ে শিক্ষকের পদ আছে ৪ হাজার ৭৭৮টি। এসব পদে শিক্ষক আছেন ১ হাজার ৩০৬ জন। পদ খালি ৩ হাজার ৪৭২টি। অর্থাৎ মৌলিক বিষয়ে ৭৩ শতাংশ পদ খালি রেখে সরকারি মেডিকেল কলেজে শিক্ষা চলছে। সরকারি ও বেসরকারি সূত্র বলছে, বেসরকারি মেডিকেল কলেজের পরিস্থিতি আরও খারাপ।
কিছু দাপ্তরিক কাজ শেষ হলে মৌলিক এসব বিষয়ের শিক্ষকেরা এখন যা বেতন পাচ্ছেন, আগামীতে প্রতি মাসে এর সমপরিমাণ ভাতা পাবেন। এ ভাতা পাবেন শুধু সরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষকেরা। এ প্রণোদনা তাঁদের সম্মানজনক জীবনযাপনে সহায়ক হবে বলে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা মনে করছেন।
মৌলিক আটটি বিষয়ের মধ্যে আছে—অ্যানাটমি, ফিজিওলজি, প্যাথলজি, ফার্মাকোলজি, বায়োকেমিস্ট্রি, মাইক্রোবায়োলজি, ফরেনসিক মেডিসিন ও কমিউনিটি মেডিসিন।
মৌলিক বিষয়ে জ্ঞান না থাকলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হওয়া কঠিন, যেমন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ হতে ফিজিওলজি, বায়োকেমিস্ট্রি ও প্যাথলজি সম্পর্কে ভালো জ্ঞান থাকতে হবে। একইভাবে ভালো সার্জন হতে অ্যানাটমি ও প্যাথলজি সম্পর্কে গভীর ধারণা থাকতে হবে।
আবু জামিল ফয়সাল, জনস্বাস্থ্যবিদ
এমবিবিএস পাস করতে হলে এই আট বিষয় পড়তেই হয়। বিষয়গুলো মেডিকেল শিক্ষার ভিত্তি তৈরি করে। একইভাবে এসব বিষয়ে ভালো জ্ঞান বা দক্ষতা অর্জন না করলে মেডিসিন, সার্জারি, পেডিয়াট্রিকস ও গাইনোকলজিতে দুর্বলতা থেকে যায়। বাংলাদেশে চিকিৎসাসেবা ও চিকিৎসাশিক্ষার দুর্বলতার অন্যতম প্রধান কারণ, মৌলিক বিষয়ে শিক্ষকের স্বল্পতা তথা শিক্ষার দুর্বলতা।
স্বাধীনতার সময় দেশে মেডিকেল কলেজ ছিল আটটি। এখন সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে শতাধিক। মেডিকেল কলেজ ও শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়লেও সমানতালে বাড়েনি শিক্ষকের সংখ্যা এবং গুণগতমান।
এ ব্যাপারে জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘সমস্যাটি পুরোনো। মৌলিক বিষয়ে জ্ঞান না থাকলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হওয়া কঠিন, যেমন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ হতে ফিজিওলজি, বায়োকেমিস্ট্রি ও প্যাথলজি সম্পর্কে ভালো জ্ঞান থাকতে হবে। একইভাবে ভালো সার্জন হতে অ্যানাটমি ও প্যাথলজি সম্পর্কে গভীর ধারণা থাকতে হবে।’
কেন এ প্রণোদনা
আটটি বিষয় মেডিকেল বা চিকিৎসাশিক্ষার ভিত্তি। কিন্তু এসব বিষয়ে শিক্ষকতা করার ক্ষেত্রে অন্য কোনো কাজ করার সুযোগ নেই। একজন মেডিসিন কিংবা শিশুরোগ–বিশেষজ্ঞ যেমন রোগী দেখে তাঁর পেশা চর্চা করতে পারেন, ওই আট বিষয়ের বিশেষজ্ঞের তাঁর বিষয়ে রোগী দেখার কোনো সুযোগ নেই। অনেকে মনে করেন, এ কারণে আট বিষয়ের প্রতি তরুণ চিকিৎসকদের আগ্রহ কম। এসব বিষয়ে কেউ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিতে বা বিশেষজ্ঞ হতে চান না।
আগেও বেশ কয়েকবার মৌলিক বিষয়ের শিক্ষকদের প্রণোদনা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল মন্ত্রণালয়। কিন্তু প্রণোদনার পরিমাণ নিয়ে চিকিৎসকদের মধ্যে অসন্তুষ্টি ছিল। এখন প্রণোদনা ভাতা শতভাগ হওয়ায় সেই অসন্তুষ্টির কথা শোনা যায়নি।
এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দলিলে বলা হয়েছে, ‘বেসিক সাবজেক্টের (মৌলিক বিষয়) শিক্ষকগণের প্রাইভেট প্র্যাকটিসের সুযোগ না থাকায় তরুণ চিকিৎসকেরা ভবিষ্যতের ক্যারিয়ার হিসেবে শিক্ষকতা বেছে না নিয়ে ক্লিনিক্যাল বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনে অধিক মনোযোগী হচ্ছেন, যা সার্বিক বিবেচনায় স্বাস্থ্য খাতের জন্য অশনিসংকেত।’
মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে সরকারি মেডিকেল কলেজ ৩৭টি। এসব কলেজে মৌলিক ৮টি বিষয়ে শিক্ষকের পদ আছে ৪ হাজার ৭৭৮টি। এসব পদে শিক্ষক আছেন ১ হাজার ৩০৬ জন। পদ খালি ৩ হাজার ৪৭২টি। অর্থাৎ মৌলিক বিষয়ে ৭৩ শতাংশ পদ খালি রেখে সরকারি মেডিকেল কলেজে শিক্ষা চলছে। সরকারি ও বেসরকারি সূত্র বলছে, বেসরকারি মেডিকেল কলেজের পরিস্থিতি আরও খারাপ।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, আগেও বেশ কয়েকবার শিক্ষকদের প্রণোদনা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল মন্ত্রণালয়। কিন্তু প্রণোদনার পরিমাণ নিয়ে চিকিৎসকদের মধ্যে অসন্তুষ্টি ছিল। এখন প্রণোদনা ভাতা শতভাগ হওয়ায় সেই অসন্তুষ্টির কথা শোনা যায়নি। এর জন্য সরকারকে বছরে ১০০ কোটি টাকার মতো ব্যয় করতে হবে।
আরও পড়ুন
জোড়াতালি দিয়ে চিকিৎসাশিক্ষা নয়
০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
জোড়াতালি দিয়ে চিকিৎসাশিক্ষা নয়
শিক্ষকতা ও গবেষণায় আগ্রহীদের কথা ভেবেই শতভাগ প্রণোদনার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের বিশেষ সহকারী অধ্যাপক মো. সায়েদুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সমস্যাটি পুরোনো। চিকিৎসকদের মধ্যে মেধাবী অংশকে উৎসাহিত করার জন্য এটা করা হয়েছে। আশা করি, এর একটি সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে চিকিৎসাশিক্ষা ও সেবার ক্ষেত্রে। প্রয়োজনে ভবিষ্যতের সরকার প্রণোদনার পরিধি বাড়াবে।’