গাজা উপত্যকায় সামরিক অভিযান নিয়ে ইসরাইলের ঘরে ঝগড়ার বিষয়টি অনেক দিন ধরেই কানাঘুষা চলে আসছে, এবার সেই ঝগড়া প্রকাশ্যে রূপ নিলো। চলতি সপ্তাহে ইসরাইলি সরকারের মধ্যে বিভক্তি আরও প্রকট হয়েছে। দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে পড়তে হয়েছে তীব্র বিরোধিতার মুখে।
ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী সরাসরি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর কাছে গাজা যুদ্ধ নিয়ে একটি সুস্পষ্ট কৌশল দাবি করে সূর চড়িয়ে বলেছেন, আট মাস ধরে চলমান যুদ্ধে যেসব এলাকা থেকে হামাস যোদ্ধাদের নির্মূলের দাবি করা হয়েছিলো, ঠিক সেখানেই ফিরে আসছে ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ যোদ্ধারা। খবর রয়টার্সের।
এই ধরনের পরিস্থিতিতে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট সোজা ভাষায় জানিয়েছেন, গাজা উপত্যকায় একটি সামরিক সরকার প্রতিষ্ঠায় ইসরাইলি পরিকল্পনা তিনি মেনে নেবেন না। যুদ্ধ শেষে গাজার শাসনভার কাদের ওপর ছেড়ে দেয়া হবে, তা নিয়ে নেতানিয়াহুর দিকনির্দেশনা না থাকায় নিরাপত্তা সংকট তীব্র হচ্ছে।
ইসরাইলি মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর কঠোর সমালোচনা করেছেন ইয়োভ গ্যালান্ট। তিনি বলেন, গাজায় যদি ইসরাইলের বেসামরিক বা সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠার কোনো সুস্পষ্ট পরিকল্পনা না থাকে তা হলে সেটা জনসম্মুখে নেতানিয়াহুর বলা উচিত। এনিয়ে তার নীরবতা নিরাপত্তা সঙ্কট তৈরি করছে।
ক্ষোভের সুরে গ্যালান্ট আরও বলেন, অক্টোবর থেকে আমি মন্ত্রিসভায় এই বিষয়টি ধারাবাহিকভাবে উত্থাপন করে যাচ্ছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো সাড়া পাইনি। এ সময় গাজা যুদ্ধের পরিকল্পনা নিয়ে প্রকাশ্যে সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে হতাশাও প্রকাশ করেন ইসরাইলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট।
মন্ত্রিসভার বৈঠকে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রীও কড়া ভাষায় প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে আক্রমণ করেন। গ্যালান্টের এমন সব মন্তব্যের জবাবে পাল্টা কড়া বার্তা দেন নেতানিয়াহু। হামাস এবং ফাতাহ’র কার্যকলাপ তুলে ধরে নেতানিয়াহু জানান, তিনি ‘ফাতাহস্তানের’ কাছে ‘হামাস্তান’ দিয়ে দিতে প্রস্তুত নন।
তিনি গ্যালান্টের নাম উল্লেখ না করে ইঙ্গিতে বলেছেন, গাজায় আট মাস ধরে চলা সংঘাতে এখনো হামাসকে ধ্বংস করতে না পারায় অজুহাত তৈরি করছেন অবসরপ্রাপ্ত এডমিরাল। তবে নেতানিয়াহুর এমন মন্তব্যে সন্তুষ্ট হতে পারেননি দেশটির যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভার মন্ত্রী ও মধ্যপন্থি সাবেক জেনারেল বেনি গান্তজও।
নেতানিয়াহুর কথার জবাবে ইসরাইলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেছেন, সিদ্ধান্তহীনতা গাজায় দুটি খারাপ বিকল্প রেখে যাবে। ইসরাইলের অভিযান শেষে হামাসই গাজা শাসন করবে। অথবা ইসরাইল সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠা করবে। এটি হামাসের ওপর চাপ কমিয়ে দেবে এবং বন্দিদের মুক্তির সম্ভাবনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
গ্যালান্ট বলেছিলেন, হামাসকে পরাজিত করার এবং সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের হাতে ৭ অক্টোবর জিম্মি হওয়া ইসরায়েলিদের পুনরুদ্ধার করার যে লক্ষ্য নেতানিয়াহু সরকার নিয়েছে, সেগুলো পূরণ করতে হলে গাজায় অবশ্যই একটি বিকল্প ফিলিস্তিনি শাসনের ভিত্তি স্থাপন করতে হবে।
তিনি আরও বলেছেন, আমাদের অবশ্যই গাজায় হামাসের শাসন ক্ষমতা ভেঙে দিতে হবে। আর তা করতে হলে আমাদের সামরিক পদক্ষেপ নিতে হবে এবং সেখানে হামাসের বিকল্প একটি শাসক গোষ্ঠি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ রকম কোনও ব্যবস্থা না নেওয়া গেলে তাদের হাতে দুটি বিকল্প ব্যবস্থা রয়েছে।
সেগুলো ইতিবাচক নয় তা উল্লেখ করে গ্যালান্ট বলেছেন, এই ধরনের বিকল্প না থাকলে সেখানে নেতিবাচক দুটি বিকল্প অবশিষ্ট থাকবে: হয় গাজায় হামাসের শাসন, নতুবা গাজায় ইসরাইলি সামরিক শাসন। তবে তিনি উল্লেখিত উভয় বিকল্পেরই বিরোধিতা করেন গ্যালান্ট।
যুদ্ধ শেষে গাজায় হামাস কিংবা ইসরাইলি সামরিক শাসন, কোনোটিই দেখতে চান না তিনি। নেতানিয়াহুকে আনুষ্ঠানিকভাবে এ রকম কোনও পরিকল্পনা ত্যাগের আহবানও জানান এই প্রতিরক্ষামন্ত্রী। গ্যালান্ট বলেন, অক্টোবরে সংঘাত শুরু হওয়ার পর থেকেই হামাসের বিকল্প একটি ফিলিস্তিনি শাসক দেখতে চান তিনি।
ইসরাইলি মন্ত্রিসভার আরেক প্রভাবশালী সদস্য বেনি গ্যান্টজ প্রতিরক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে একমত পোষণ করেন। তিনি বলেন, গ্যালান্ট সত্য কথা বলেছেন এবং যে কোনো মূল্যে দেশের জন্য সঠিক কাজটি করা নেতৃত্বের দায়িত্ব। মন্ত্রিসভার অন্যান্য মধ্যপন্থি সদস্যরাও গ্যালান্টের পক্ষ নিয়েছেন
সাম্প্রতিক এই ঘটনার মধ্য দিয়ে গাজা যুদ্ধ নিয়ে ইসরাইলের সরকারে বিভাজন ও বিভক্তি প্রকাশ্যে চলে এলো। বিশ্লেষকরা বলছেন, সংকটময় সময়ে এটা সত্যিই ইসরাইলের যুদ্ধ মন্ত্রিসভায় বড় ধরনের বিভক্তি। এতে করে আট মাস ধরে চলা যুদ্ধ নিয়ে আরও জটিল পরিস্থিতি হতে বলে মনে করছেন তারা।